সর্বোচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও দেশের নানান প্রান্তে রান্নার গ্যাসের ভর্তুকির জন্য গ্রাহকদের আধার কার্ড দেখাইতে বাধ্য করা হইতেছে কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী বলিয়াছেন, গ্যাসের ডিলাররা নাকি ভুয়া গ্রাহক চিহ্নিত করিতেই আধার কার্ড দেখানোকে বাধ্যতামূলক ঘোষণা করিয়াছেন। আধার কার্ড লইয়া সাম্প্রতিক হয়রানির জন্য তাঁহার মন্ত্রক উপভোক্তাদেরই দায়ী করিয়াছে। যে জেলাগুলিতে গ্যাসের ভর্তুকির টাকা সরাসরি গ্রাহকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পৌঁছাইয়া দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হইয়াছে, সেখানে নাকি অনেক গ্রাহক আধার কার্ড হাতে পাইয়াও তাহা সংশ্লিষ্ট দোকান এবং ব্যাঙ্কে নথিভুক্ত করান নাই। গ্যাসের ভর্তুকি এবং তাহাতে আধার কার্ডের ভূমিকা লইয়া যে বিচিত্র ধাঁধা তৈরি হইয়াছে, তাহার সমাধানসূত্রটি প্রকাশ করিয়া অন্যকে দোষী সাব্যস্ত করিবার খেলাটি খেলিলে হইত না?
মূল প্রশ্ন আধার কার্ড নামক পরিচয়পত্রটিকেই ‘একক’ হিসাবে চিহ্নিত করিবার যাথার্থ্য লইয়া। সন্দেহ নাই, দেশের সব মানুষকে একটি একক নম্বরে দাগাইয়া দিতে পারিলে রাষ্ট্রের সুবিধা হয়। ইতিবাচক সুবিধা ভর্তুকিকে অনেক বেশি নিখুঁত করিয়া তোলা যায়, সমস্যায় থাকা জনগোষ্ঠীকে সহজে চিহ্নিত করিয়া ফেলা যায়। যে কোনও ব্যবস্থাই যে প্রায়োগিক সুবিধাকে পছন্দ করে, আধার কার্ড সেই সুবিধা করিয়া দিতে পারে। কিন্তু সুবিধা হইবে বলিয়াই একক পরিচয়পত্র প্রত্যেকের উপর চাপাইয়া দেওয়া হইবে, এই পরিচয়পত্রটি না থাকিলে নাগরিক রাষ্ট্রের নিকট তাহার অধিকার দাবি করিতে পারিবে না এমন ব্যবস্থা অনৈতিক। আধার কার্ড একটি পরিচয়পত্রমাত্র, তাহার অধিক কিছু নহে। পাসপোর্ট যেমন। যে কোনও নাগরিক স্বচ্ছন্দে সিদ্ধান্ত করিতে পারেন যে তিনি পাসপোর্ট চাহেন না। পাসপোর্ট না থাকিলে তিনি দেশের বাহিরে যাইতে পারিবেন না। কিন্তু, পাসপোর্ট নাই বলিয়া তাঁহার ভোটদানের অধিকার কাড়িয়া লওয়া যায় না। আধার কার্ডেরও এমন নির্দিষ্ট অধিকারক্ষেত্র থাকুক। রাষ্ট্রের নিকট তিনি কোন পরিষেবা চাহেন, কোনগুলি চাহেন না, এক জন নাগরিকের তাহা স্থির করিবার অধিকার আছে। সংশ্লিষ্ট পরিচয়পত্র দেখাইতে পারিলে সেই পরিষেবা হইতে তাঁহাকে বঞ্চিত করিবার অধিকার রাষ্ট্রের নাই। আধারকেই একমাত্র পরিচয়পত্র হিসাবে দেখিয়া সরকার সেই অনধিকারচর্চা করিতেছে।
আধার বিষয়ে যে আপত্তিগুলি উঠিয়াছে, তাহা উড়াইয়া দেওয়ার মতো নহে। সব নাগরিক বিষয়ে সমস্ত তথ্য একত্র করিয়া রাখা নাগরিকদের নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর হইতে পারে। বিশেষত সেই তথ্য যখন বেসরকারি (এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অদক্ষ) কর্মীদের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হইতেছে, তখন তথ্য ফাঁস হইয়া যাইবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। তাহার অপব্যবহারের সম্ভাবনাও। কেবল অশুভ তৃতীয় শক্তি হইতেই যে আশঙ্কা, তাহাও নহে প্রশাসন যে ধর্ম, বর্ণ, জাতি ইত্যাদির ভিত্তিতে নাগরিকদের চিহ্নিত করিবার জন্য এই তথ্য ব্যবহার করিবে না, তাহার নিশ্চয়তা নাই। কিন্তু এই আশঙ্কাগুলির সব কয়টিই যদি ভুলিয়াও যাওয়া যায়, নাগরিকের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের প্রশ্নটি উড়াইয়া দেওয়ার কোনও উপায় নাই। নিজের সম্বন্ধে সব তথ্য সরকারের হাতে তুলিয়া দিতে কাহারও আপত্তি থাকিতেই পারে। এই আপত্তি নাগরিকের মৌলিক অধিকারভুক্ত। আধার নির্দিষ্ট প্রয়োজনভিত্তিক স্বেচ্ছাধীন পরিচয়পত্র হইয়া থাকুক। ‘একমাত্র’ নহে। |