এক বৎসর। কালের কপোলতলে বিন্দুসম অশ্রুও নহে। তবু এক বৎসর যে কতখানি সময়, দেখাইয়া দিয়া গিয়াছেন দিল্লির রাজপথে অত্যাচারিতা মেয়েটি। তার্কিক তর্ক জুড়িবেন, কী আর এমন হইয়াছে, আরও অনেক কিছু প্রত্যাশিত ছিল, রাজধানী বা অন্যান্য শহর-মফস্সল-গ্রাম এখনও মেয়েদের পক্ষে একই রকম অনিরাপদ, এখনও সংবাদ শিরোনামে ধর্ষণ প্রাত্যহিক। উত্তরে কেবল বলিবার: ঘরে পাড়ায় বিদ্যালয়ে কলেজে অফিসে রাস্তায় বাসে ট্রামে ট্রেনে, আক্ষরিক ভাবে সর্বত্র যে ভাবে ধর্ষণ শব্দটি রোজ উচ্চারিত হইতেছে, যে ভাবে তাহা শিশু হইতে বৃদ্ধ সকলের নিত্যব্যবহৃত শব্দবন্ধের অন্যতম হইয়া উঠিয়াছে, তাহাই তো ২০১২’র ১৬ ডিসেম্বর-এর উত্তরাধিকার। এই উত্তরাধিকার দুর্ভাগ্যজনক হইতে পারে, কিন্তু পূর্ণমাত্রায় বাস্তবসম্মত। সত্য অভিজ্ঞতার বাস্তবকে এই ভাবেই রাখঢাকের আচ্ছাদন টুটাইয়া প্রকাশ্য স্বীকৃতির আলোয় আসিতে হইবে। আর কিছু যদি না-ও হয়, এই স্বীকৃতিটুকুই এক বৎসরের অগ্রগতি। ২০১৩ সালের শেষে দেশব্যাপী কিশোরী কন্যারা পথে বাহির হইবার আগে যে বিশেষ সতর্কতার কথা এক বার ভাবিয়া লয়, তাহাই এক বৎসরের অগ্রগতি। সংবাদপত্রে যে ভাবে ধর্ষণ-নির্যাতনের সংবাদ ভিতরের পৃষ্ঠা হইতে রাতারাতি প্রথম পৃষ্ঠায় স্থান করিয়াছে, সংখ্যায় বহুগুণ বাড়িয়াছে, তাহা এই এক বৎসরের তীক্ষ্নায়িত জনচেতনার ফল। এক বৎসর কখনও এক যুগ।
চেতনা এক বার আসিলে আইন শাসন বিচারেও তাহার ছাপ পড়িতে বাধ্য। এই লাল-ফিতার ফাঁসের দেশে বর্মা কমিশনের রিপোর্টটি যে দ্রুততায় সাধিত হইয়াছিল, তাহা স্মরণীয় হইয়া রইল। রিপোর্টের অনেকাংশই পরবর্তী আইনে প্রতিফলিত হয় নাই। তবে এই রিপোর্টই কিন্তু সম্ভব করিয়াছে দৃশ্যকাম, পশ্চাদ্ধাবন, মৌখিক নির্যাতন ইত্যাকার বিষয়কে ‘নির্যাতন’ তালিকায় আনিয়া অপরাধ হিসাবে নথিভুক্ত করাইতে। ধর্ষণ বিরোধী যে আইনটি পাশ হইয়াছে, তাহা ‘ধর্ষণ’ শব্দটির সংজ্ঞাকে অনেকখানি বাড়াইয়া এক বহুপ্রতীক্ষিত সামাজিক ন্যায় সাধন করিয়াছে। প্রসঙ্গত, যৌন নির্যাতন ভিন্ন অন্যান্য ক্ষেত্রেও কিছু প্রশ্ন উঠিয়া আসিয়াছে, যেমন, অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীর বিচারের মাপকাঠি। বহু বিতর্কের পরও, আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও এই প্রশ্নের এখনও জ্বলন্ত প্রাসঙ্গিকতা। গণতন্ত্রে আলোচনা ও বিতর্কের বিকল্প নাই, বিশেষত আইন ও বিচারের নীতির প্রসঙ্গে: এই প্রক্রিয়া অক্লান্ত থাকুক, ইহাই আপাতত কাম্য।
সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে জনসাধারণের চেতনা বৃদ্ধির ছাপ পড়িলেও এই দুইয়ের মধ্যে কিন্তু বেশ বড় একটি ব্যবধানও লক্ষণীয়। স্পষ্টত, এই নূতন আইন বলবৎ করিবার ভার যাঁহাদের উপর, তাঁহারা এখনও এ দেশে এই দায়িত্ব পালনের যোগ্য হইয়া উঠেন নাই। প্রচারমাধ্যমের বড়কর্তাই হউন, বিচারালয়ের মান্য বিচারপতিই হউন, অসংবেদনের অভিযোগ সর্ব স্তরে। এবং রহিয়াছে প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রিতা। নারীসুরক্ষার লক্ষ্যে নির্ধারিত এক হাজার কোটি টাকার ‘নির্ভয়া ফান্ড’ এখনও কার্যকর হয় নাই, কোন পদ্ধতিতে তাহা ব্যয়িত হইবে, তাহার নির্দেশিকাও নিশ্চিত হয় নাই। দিল্লির নাগরিক সমাজের অভিযোগ, এখনও রাস্তাঘাটে নিরাপত্তার নূতন ব্যবস্থা লক্ষিত হয় নাই। কলিকাতায় অনিরাপদ বলিয়া পরিচিত অঞ্চলেও পর্যাপ্ত পুলিশ প্রহরা দেখা যায় নাই এখনও। সমাজ যে গতিতে সচেতনতার পথে হাঁটিতেছে, প্রশাসন তথা রাষ্ট্র কিন্তু তাহার সহিত পাল্লা দিতে ব্যর্থ। অথচ যে কোনও বৃহৎ সামাজিক সংস্কারের ইতিহাস বলে, বিপরীতটিই ঘটিবার কথা ছিল। রাষ্ট্রেরই পথ দেখাইবার কথা ছিল। অগত্যা, রাষ্ট্র যাহাতে শেষ পর্যন্ত পরিবর্তনের হালটি শক্ত করিয়া ধরিতে পারে, জনসাধারণের বিনিদ্র প্রহরা দিয়াই তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। |