দলের থেকে শনিবার ইঙ্গিতটা মিলেছিল। রবিবার মোর্চা প্রধান বিমল গুরুঙ্গ নিজেই মেনে নিলেন, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে দার্জিলিং আসনে স্থানীয় কাউকে প্রার্থী করার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই ভাবছেন তাঁরা। পাশাপাশি এ দিন আত্মসমালোচনার সুরও শোনা গেল তাঁর গলায়। বিশেষ করে সুবাস ঘিসিঙ্গকে নিয়ে। দশ বছর আগে যাঁকে পাহাড় থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, যাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পরেও পাহাড়ে অন্ত্যেষ্টি করতে দেননি, তাঁকেই মানবিক কারণ দেখিয়ে ফিরে আসার আহ্বান জানালেন গুরুঙ্গ। নিজের সিদ্ধান্তে ভুলের প্রসঙ্গে এই সূত্রে বললেন, “সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় ভুল হয়ে যায়। তা শুধরে নেওয়ার অবকাশও থাকে। যেমন আমি জিটিএ চিফের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলাম। এখন মানুষ আমাকে সেই পদে চান।”
গুরুঙ্গের বক্তব্য, মানুষের চাহিদা তাঁকে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। আর সেই চাহিদার কথা মাথায় রেখেই পাহাড়ে স্থানীয় প্রার্থী দেওয়ার কথা বিবেচনা করে দেখছে তাঁর দল। আগামী ২০ ডিসেম্বর কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে গুরুঙ্গের একান্তে দেখা করার কথা। তার আগে শনিবার শিলিগুড়িতে মোর্চার প্রচারসচিব হরকাবাহাদুর ছেত্রী এই প্রসঙ্গে সওয়াল করেছিলেন। তাঁর ওই বক্তব্যকে গুরুঙ্গ সমর্থন করেন না উড়িয়ে দেন, তা নিয়ে মোর্চার অন্দরেই প্রশ্ন ওঠে। |
এ দিন গুরুঙ্গ তো হরকার মতকে খারিজ করলেনই না, বরং তাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বার্তা দিলেন, পাহাড়ে সর্বসম্মত ভাবে স্থানীয় প্রার্থী করার বিষয় নিয়েই ভাবনাচিন্তা চলছে। তিনি বলেন, “আমাদের প্রচারসচিব হরকাবাহাদুর ছেত্রী স্থানীয় কাউকে প্রার্থী করার বিষয়টি নিয়ে বলেছেন। এটা তাঁর ব্যক্তিগত মত। তবে আমরা এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিইনি। সব কিছু নিয়ে দলে আলোচনা হবে।” তাঁর বক্তব্য, “পাহাড়বাসীর দাবি-আবেগকে মর্যাদা দিয়ে আমরা খোলা মনেই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।”
মোর্চার অন্দরের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হবে, এ দিনের মোর্চার বৈঠকের গোড়াতেই সেই প্রসঙ্গ ওঠে। সেখানে দলের ধৃত নেতাদের মুক্তি, সিআরপি প্রত্যাহার, নেতা-কর্মীদের পুরনো মামলা থেকে রেহাই এই বিষয়গুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এর পরে ওঠে লোকসভা ভোটের প্রস্তুতি অন্য দলগুলি কী ভাবে নিচ্ছে, সেই প্রসঙ্গ।
মোর্চার একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, আলোচনায় ওঠে তৃণমূলের প্রসঙ্গও। মোর্চার কোনও শীর্ষ নেতাকে দলে টেনে তৃণমূল প্রার্থী করলে তার ফল কী হবে, তা নিয়ে চুলচেরা বিতর্ক হয়। মোর্চার এক প্রথম সারির নেতা জানান, তখনই জিএনএলএফ-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা এক প্রাক্তন বিধায়কের প্রসঙ্গও ওঠে। পাহাড়ের এই নেতা মোর্চা মনোভাবাপন্ন হলেও বর্তমানে কিছুটা দূরে সরে রয়েছেন। তাঁকে তৃণমূল দলে টেনে প্রার্থী করতে পারে কি না, তা নিয়ে আলোচনা হয়।
ঘটনাচক্রে, ওই নেতাকে রবিবার রাতেই তৃণমূলের পাহাড়ের এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কলকাতার উদ্দেশে রওনা হতে দেখা গিয়েছে। তাঁকে প্রার্থী করলে জিএনএলএফ-ও সমর্থন করতে পারে বলে মনে করছেন কয়েক জন। এই পরিস্থিতিতেই ঘিসিঙ্গকে পাহাড়ে ফেরার জন্য আহ্বান জানানোর সিদ্ধান্ত নেন মোর্চা নেতৃত্ব। তাতে আগামী দিনে পাহাড়ের স্বার্থে সর্বসম্মত প্রার্থী দেওয়ার বৈঠকে ঘিসিঙ্গ বা তাঁর অনুগামীদের আনাটা সহজ হবে বলেই মোর্চা নেতাদের অনেকের অভিমত। যে ষষ্ঠ তফসিলের দাবিকে সামনে রেখে ঘিসিঙ্গ ফের পাহাড়ে পা রাখতে মরিয়া, তা রুখতে পাহাড়ের সব সম্প্রদায়কে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তোলা হবে বলেও সিদ্ধান্ত নেন মোর্চা নেতৃত্ব।
ওই বৈঠকের পরে গুরুঙ্গ বলেন, “আমরা চাই সুবাস ঘিসিঙ্গ পাহাড়ে ফিরে আসুন। মানবিক কারণেই ওঁকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি।” তাৎপর্যপূর্ণ হল, এর পরেই গুরুঙ্গ জানিয়ে দেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে পাহাড়ে বসবাসকারী সব সম্প্রদায়কে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আর্জি জানাবেন। ঘটনা হল, ঘিসিঙ্গ দার্জিলিং পাহাড়কে ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় আনার যে দাবি তুলেছেন, তা মানা হলে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে পাহাড়ের বাসিন্দা সব সম্প্রদায়ই আদিবাসী হিসেবে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা পাবেন। মোর্চার এক প্রথম সারির নেতা জানান, যে ভাবে জিএনএলএফ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তাতে তাঁরা ঘিসিঙ্গ সম্পর্কে অবস্থান বদল করতে এক রকম বাধ্য হয়েছেন।
অন্য দিকে তৃণমূলও পাহাড়ে জনপ্রিয় হচ্ছে। লেপচা উন্নয়ন বোর্ড গড়ার পরে সেই জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে। আগামী দিনে তামাঙ্গদের সভায় যোগ দিতে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা করে কিছু করার ইচ্ছেও প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এই পরিস্থিতিতে শাসক দলের সঙ্গে শত্রুতা না বাড়িয়ে বরং ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর ব্যাপারে গুরুঙ্গের উপরে চাপ দেন হরকা-সহ দলের অনেকে। মোর্চার শীর্ষ নেতাদের একাংশ জানান, সদ্যসমাপ্ত ৫ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফলে পরে আগামী দিনে নয়াদিল্লিতে তৃণমূল যে বড় ভূমিকা নিতে পারে, সেই সম্ভাবনা কিছুটা হলেও তৈরি হয়েছে। তাই সব দিক মাথায় রেখে চলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা খোলাখুলি বলতে বাধ্য হয়েছেন গুরুঙ্গ।
গুরুঙ্গের আত্মসমালোচনার বিষয়টিকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করলেও তৃণমূলের তরফে কেউ কোনও মন্তব্য করতে চাননি। দলের এক শীর্ষ নেতা জানান, ক’দিন পরে যেখানে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হবে, সেখানে আগ বাড়িয়ে কোনও মন্তব্য করা ঠিক হবে না। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “এটা অন্য দলের বিষয়, এ ব্যাপারে আমি কোনও কথা বলব না।”
জিএনএলএফ-ও পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ইন্দ্রনারায়ণ প্রধান বলেন, “সুবাস ঘিসিঙ্গের স্ত্রীর মৃত্যুর পরে দেহ নিতে বাধা দিয়েছিলেন বিমল গুরুঙ্গরা। অন্ত্যেষ্টি শিলিগুড়িতে হয়। এখন মানবিকতার কথা বললে হবে?” তাঁর কথায়, “লোকসভা ভোটের আগে এ সব কথার মানে কী, সেটা সকলেই বোঝেন। আমরা পরিস্থিতির উপরে নজর রাখছি। যথা সময়ে সুবাস ঘিসিঙ্গ যা বলার বলবেন।”
|