সারা বিশ্বের জেল ঘুরে বন্দিদের ভালমন্দ দেখাই তাঁদের কাজ। কিন্তু দুনিয়ার জেল চষে বেড়ানো মানুষগুলি পশ্চিমবঙ্গে কারাবন্দিদের হালহকিকত দেখতে এসে একই সঙ্গে চমকে গিয়েছেন এবং হতাশও হয়েছেন খুব।
চমক কীসের? হতাশাই বা কেন?
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিতেরা গান গাইছেন পাড়ার পুজোর মঞ্চে। বাংলার বন্দিদের অভিনীত নাটক বা গীতি-আলেখ্য মঞ্চস্থ হচ্ছে মুম্বইয়ের বিভিন্ন দুর্গাপুজোর মণ্ডপে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের হাত ধরে এই ভাবেই মুক্তি ও মানবাধিকারের স্বাদ পাচ্ছেন এ রাজ্যের বন্দিরা। দেখেশুনে চমকে গিয়েছেন ব্রিটেনের তাবড় কারা-বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, অনেক উন্নত দেশেও সাংস্কৃতিক পদ্ধতিতে বন্দিদের সংশোধনের প্রক্রিয়া তেমন চোখে পড়েনি তাঁদের। এখানে সেটা দেখে তাঁরা রীতিমতো উৎসাহিত।
কিন্তু চমক শুধু একটা দিক। অন্য ছবিটা রীতিমতো হতাশ করেছে তাঁদের। হতাশার কারণ, জেলে ওই বন্দিদেরই থাকতে হচ্ছে এতটুকু জায়গায় ঠাসাঠাসি করে। কখনও কখনও ছোট্ট ওয়ার্ডে ডর্মিটরিতে ঘেঁষাঘেঁষি করে আছেন ৬০-৭০ জন।
রাজ্যের জেলে পরস্পরবিরোধী এই ছবি দেখে ব্রিটেনের তাবড় জেল বিশেষজ্ঞেরা অবাক। তাঁদের মধ্যে আছেন আন্তর্জাতিক কারা-বিশেষজ্ঞ জন পদমোর-ও। প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে এ রাজ্যের বন্দিদের সাংস্কৃতিক পদ্ধতিতে সংশোধনের প্রক্রিয়ার কথা শুনে পদমোর চমৎকৃত। তাঁর বক্তব্য, বিশ্বের খুব কম জায়গায় সাংস্কৃতিক পদ্ধতিতে সংশোধনের প্রক্রিয়া এত ব্যাপক ভাবে চালু হয়েছে। স্বভাবতই আন্তর্জাতিক কারা-বিশেষজ্ঞের এই প্রশস্তিবাক্যে কারাকর্তারা গর্বিত। প্রশিক্ষণে যোগ দেওয়া ডিআইজি (কারা) সুদীপ্ত চক্রবর্তী বলেন, “রাজ্যের বিভিন্ন জেলে কী ভাবে নাটক-ছবি আঁকা-নাচগান শেখানো হয়, পদমোরেরা মনোযোগ দিয়ে তা শুনেছেন।” কারাকর্তারা জানান, বন্দিরা যে কয়েক বছর ধরে জেলের বাইরে, এমনকী ভিন্ রাজ্যে লাগাতার অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছেন এবং তা করতে গিয়ে এখনও পর্যন্ত বন্দি পালানোর তেমন কোনও খবর নেই, শুনে অবাক হয়েছেন ব্রিটেনের কারা-বিশেষজ্ঞেরা। ব্রিটেনে এমন ‘কালচারাল থেরাপি’ বা সাংস্কৃতিক শুশ্রূষা চালু করার ব্যাপারে উৎসাহ দেখিয়েছেন তাঁরা।
তবে কালচারাল থেরাপি যতটা গর্বের, বাংলার মাথা ততটাই নিচু করে দিয়েছে বন্দিদের থাকার ব্যবস্থা। জায়গার অভাবে এ রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলেই বন্দিদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে পদে পদে। ব্রিটেনে সাধারণত একটি ঘরে এক জনই বন্দি থাকেন। কিন্তু এখানকার বেশির ভাগ জেলের ওয়ার্ডে রাখা হয় ৬০ থেকে ১৫০ জন বন্দিকে। এর প্রতিকার হচ্ছে না কেন? কারা দফতরের এক কর্তা বলেন, “আমরা নিরুপায়। রাজ্যে জেলের সংখ্যা বাড়ার কথা। কিন্তু বাড়ছে না। তার উপরে বিচারাধীন বন্দির ভিড় বাড়ছে। উপরমহলে বারবার জানিয়েও সুরাহা হয়নি।”
এই অবস্থায় রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্দেশিকা মেনে বন্দিদের মানবাধিকার, নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য-সুরক্ষার ব্যবস্থা কী ভাবে আরও উন্নত করা যায়, সেই বিষয়ে পাঠ দিতে ‘ট্রেনিং ফর দ্য ট্রেনার্স’ পাঠ্যক্রমের আয়োজন করা হয়েছে দেশের তিন জায়গায়। কলকাতা ছাড়াও এই তালিকায় রয়েছে লখনউ আর চণ্ডীগড়। কলকাতায় যোগ দিয়েছেন পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির জনা পঁচিশ কারা আধিকারিক। তাঁদের মধ্যে ২০ জনই বাংলার। কারা দফতর সূত্রের খবর, প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষিতেরা অন্য কারাকর্তাদের পাঠ দেবেন। এ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আধিকারিকদের মধ্যে বাছাই করা কয়েক জনকে জুনে নিয়ে যাওয়া হবে ব্রিটেনে। ঘুরে দেখানো হবে সেখানকার বিভিন্ন জেল। রাজ্যের কারা দফতরের কর্তারা বলছেন, “সারা দেশে জেল নিয়ে এ ধরনের প্রশিক্ষণ এই প্রথম। এর মাধ্যমে সারা দেশের কারা পরিষেবা উন্নত হবে।” |