যেখানে যেমন কাজ, সেখানে তেমন লোক। সংখ্যা, যোগ্যতা, পরিকাঠামো সবের নিরিখেই প্রয়োজন অনুযায়ী কর্মী রাখতে হবে, যাতে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ ঠিকঠাক উতরে যেতে পারে। প্রয়োজনের বাড়তি নয়, কমও নয়। সফল পরিষেবার স্বার্থে এই রকম যথাযথ ও পেশাদার কর্মী-বিন্যাসই যে আধুনিক পরিচালনব্যবস্থার মূল কথা, অবশেষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা ঠেকে শিখেছে।
এবং শিক্ষার প্রথম ধাপ হিসেবে স্বাস্থ্য পরিষেবায় নতুন কর্মী-বিন্যাসের নীতি প্রয়োগ করে বড়সড় রদবদল আনা হয়েছে। সুফলও মিলতে শুরু করেছে বলে কর্তাদের দাবি। নবান্ন-সূত্রের খবর: স্বাস্থ্যের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে রাজ্য প্রশাসন এ বার অন্যান্য দফতরেও সময়োচিত কর্মী-বিন্যাস নীতি প্রয়োগে উদ্যোগী হয়েছে।
বস্তুত কর্মী-বিন্যাসে পেশাদারিত্বের অভাবের ছবি প্রশাসনের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে। রাজ্যের কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতর সূত্রেরই খবর, বহু জায়গায় কর্মীর অভাবে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আবার অজস্র জায়গায় কাজের তুলনায় কর্মী বিপুল। যেমন, স্বাধীনতার পরে তৈরি হওয়া উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতরে এখন কার্যত কাজ নেই, তবে অঢেল কর্মী। এ দিকে নতুন তৈরি আদিবাসী উন্নয়নে লোকাভাবে কাজ আটকে যাচ্ছে।
ভারসাম্যের এ হেন সমস্যা মেটাতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনে যথাযথ কর্মী-বিন্যাসে জোর দিয়েছেন। নবান্নের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, প্রশাসন পরিচালনার কার্যবিধিতে (রুলস অফ বিজনেস) এই সংক্রান্ত বাঁধা-ধরা নিয়ম না-থাকায় এ যাবৎ বিশেষ এগোনো যায়নি। মুখ্যমন্ত্রীর মনোভাব জেনে নতুন পথে হাঁটার কথা ভাবা হচ্ছে। “একটা কমিটি গড়া হয়েছে। তারাই ঠিক করবে, কাকে কোথায় বদলি করা হবে। শুধু এক দফতর থেকে অন্য দফতর, কিংবা সচিবালয় থেকে ডিরেক্টোরেটে নয়। দরকারে সরকারি দফতর থেকে অধিগৃহীত সংস্থায় বদলি হবে।” বলেন তিনি।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চাকাও গড়াতে শুরু করেছে। সম্প্রতি বিপর্যয় মোকাবিলার সাত জন ‘উদ্বৃত্ত’ কর্মীকে চিহ্নিত করে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য দফতরে যা হচ্ছে, তাকে ‘এমপ্লয়ি ম্যানেজমেন্ট’-এর আদর্শ প্রক্রিয়া হিসেবে অভিহিত করছেন নবান্নের কর্তারা। তাঁদের দাবি: বাড়তি খরচ কিংবা নতুন লোক নিয়োগ না-করে স্রেফ বর্তমান ব্যবস্থায় খানিক অদল-বদল ঘটিয়েই যে স্বাস্থ্য পরিষেবা অনেকটা চাঙ্গা করা সম্ভব, নতুন উদ্যোগের ফলাফলে তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। দফতরের সর্বত্র নয়া নীতিটি কার্যকর করা গেলে অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই স্বাস্থ্য পরিষেবার বহর অন্তত ৩০% বাড়ানো যাবে বলে কর্তারা আশাবাদী।
এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তী ব্লক হাসপাতালকে ‘মডেল’ হিসেবে খাড়া করছেন তাঁরা। নদী উজিয়ে বহু দুর্গম অঞ্চলের রোগীরা সেখানে আসেন, অথচ সাধারণ প্রসবের ব্যবস্থা থাকলেও সিজারিয়ান প্রসবের সুযোগ ছিল না। এখন তা পাওয়া যাচ্ছে। কী ভাবে?
স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান, চিকিৎসক সুব্রত মৈত্র বলেন, “বাসন্তীতে গাইনি রয়েছেন। কিন্তু অ্যানাস্থেটিস্ট ছিলেন না। আবার গোসাবায় অ্যানাস্থেটিস্ট থাকলেও অপারেশনের অন্য পরিকাঠামো ছিল না।” কমিটির সুপারিশে গোসাবার অ্যানাস্থেটিস্টকে বাসন্তীতে আনা হয়েছে। “বাসন্তী বা গোসাবা, কোথাও সিজারিয়ান হচ্ছিল না। এখন বাসন্তীতে দিব্যি হচ্ছে। সরকারি কোষাগার থেকে বাড়তি বরাদ্দেরও দরকার পড়েনি।” বলছেন সুব্রতবাবু।
শুধু বাসন্তী-গোসাবা নয়, বিভিন্ন জেলা ঘুরে এসে তাঁরা এমন বিস্তর সুপারিশ পেশ করেছেন। বস্তুত স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগটির পিছনে বিশেষজ্ঞ কমিটির এই সব সুপারিশেরই মুখ্য ভূমিকা। মানবসম্পদ উন্নয়নের (এইচআরডি) সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞেরা যদিও মনে করছেন, এ বিষয়ে পেশাদার সংস্থাকে দিয়ে সমীক্ষা চালালে আরও ভাল ফল মিলতে পারত। পেশাদারদের সাহায্য সরকার নিল না কেন?
সুব্রতবাবুর ব্যাখ্যা, “এখনও তেমন প্রয়োজন অনুভব করিনি। আশা করছি, আমরাই ব্যাপারটা উপযুক্ত চেহারায় আনতে পারব।” ওঁদের উদ্যোগকে অবশ্য সাধুবাদ জানিয়েছেন বিভিন্ন সংস্থার এইচআর-কর্তারা। তাঁদের মতে, এর জেরে রাজ্যের কর্মসংস্কৃতির চিত্র বদলে যেতে পারে। মানবসম্পদ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ বীর্যেন্দু গুপ্তের কথায়, “বিশ্বের সব দেশ এই নীতি অনুসরণ করছে। ফলও মিলছে।” এক সংস্থার এইচআর-কর্তা অশেষরঞ্জন জয়সওয়াল বলেন, “শুধু কর্মী বাড়িয়ে পরিষেবা বৃদ্ধি সম্ভব নয়। ঠিক কর্মীকে ঠিক জায়গায় বসানো হচ্ছে কি না, সেটাই সবচেয়ে জরুরি।” আর একটি সংস্থার এইচআর জেনারেল ম্যানেজার অভিজিৎ ভট্টাচার্যের মন্তব্য, “নতুন চাকরি হল নতুন বিয়ের মতো। ঠিকঠাক মানিয়ে নিলে কম কর্মী দিয়েই অনেক বেশি কাজ পাওয়া যাবে।”
বাসন্তীকে যে ভাবে সমৃদ্ধ করা গেল, সে রকম আর কোনও পরিকল্পনা?
স্বাস্থ্য দফতরের খবর, তাদের পরবর্তী লক্ষ্য গার্ডেনরিচ স্টেট জেনারেল হাসপাতাল। বছর দুয়েক আগে ১৫ শয্যার হাসপাতালটির শয্যাসংখ্যা বাড়িয়ে ৬৮ করা হয়েছে। অনুমোদিত হয়েছে চিকিৎসক-সহ চল্লিশটি নতুন পদ। অথচ পরিষেবা বলতে শূন্য, যার জন্য মূলত সরঞ্জামের অভাবের দিকে আঙুল উঠেছে। অন্য দিকে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ ২৪ পরগনা-হাওড়া-হুগলির বেশ কিছু ব্লক হাসপাতালে বসানো যন্ত্র কাজেই লাগছে না, কারণ টেকনিশিয়ান নেই। সেগুলো এনে গার্ডেনরিচকে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে।
অর্থাৎ, কর্র্মীর পাশাপাশি পরিকাঠামোরও যথাযথ বিন্যাস। স্বাস্থ্যকর্তারাই স্বীকার করছেন, কর্মী-পরিকাঠামোর যুগলবন্দি বহু জায়গাতেই গড়ে ওঠেনি। যেমন কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যালে রেডিওথেরাপি’র পরিকাঠামো না-থাকলেও রেডিওথেরাপি’র চিকিৎসক বহাল বছরের পর বছর। কোচবিহার হাসপাতালেও রেডিওথেরাপি’র এমডি বসে বসে মাইনে পাচ্ছেন। কর্তাদের মতে, এ সবই মানবসম্পদ অপচয়ের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
এই ঘাটতি দূর করতে এ বার ঠিক জায়গায় ঠিক লোককে বসানোর দিকে নজর পড়েছে। সুষ্ঠু পরিষেবার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে প্রক্রিয়াটিকে অভিহিত করছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন, এখন হাতে যা আছে, তা-ই ঠিকঠাক কাজে লাগিয়ে সর্বোত্তম ফল আদায় করা হোক। আমরা তা-ই করছি।”
বিশ্বরঞ্জনবাবুর পর্যবেক্ষণ, “বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভাব আছে ঠিকই। কিন্তু তাই ভেবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না! আমরা আশা করছি, সাধ্যের মধ্যে থেকে যথাযথ বিকল্পের সংস্থান করতে পারলে ছবিটা বদলে যাবে।”
তবে এখানে উঠছে কিছু প্রশ্নও। আসছে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের প্রসঙ্গ, যেখানে অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজ থেকে সার্জনদের এনে স্রেফ বসিয়ে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ। কারণ, ওখানে জটিল অস্ত্রোপচারের পরিকাঠামো তৈরি নেই। এমনকী, সাগর দত্তে নবজাতক (নিওনেটাল) বিভাগও না-থাকলেও এসএসকেএমের এক নবজাতক চিকিৎসককে ওখানে বদলি করার নজিরও মজুত। “অহেতুক অনেককে বদলি করা হয়েছে। আবার বহু জায়গায় পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও ডাক্তারের অভাবে পরিষেবা মার খাচ্ছে।” আক্ষেপ এক স্বাস্থ্যকর্তার।
এ সবও কি বিশেষজ্ঞ কমিটির নজরে থাকছে? কমিটির এক সদস্যের জবাব, “তালিকা তৈরি হয়েছে। ধাপে ধাপে সবই বদলানোর চেষ্টা হবে।” |