রাজ্য সরকার চায় নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখতে, যাতে ব্যয়ের বোঝা অতিরিক্ত মাসুল হয়ে আম গ্রাহকের ঘাড়ে চেপে না-বসে। যে কারণে এ বার বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মহার্ঘ বিদেশি কয়লা আমদানিতে দাঁড়ি টানতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এমএসটিসি থেকেও আর দামি কয়লা কেনা হবে না।
বিদ্যুৎ দফতরের খবর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পরেই নিগমের পরিচালন পর্ষদের বৈঠকে এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী অর্থবর্ষ (২০১৪-১৫) থেকে কয়লা আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিচ্ছে নিগম। এর আগে নিগমের পরিচালন পর্ষদ আগামী অর্থবর্ষে ১৫-২০ লক্ষ টন কয়লা আমদানির অনুমতি দিয়েছিল। সেই অনুমোদনও এখন তারাই বাতিল করে দিয়েছে।
দেশের অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র যখন কয়লার ঘাটতি মেটাতে আমদানির উপরে নির্ভরশীল, তখন পশ্চিমবঙ্গের এ হেন সিদ্ধান্তকে বিদ্যুৎ-শিল্পমহলের একাংশ ‘সাহসী পদক্ষেপ’ হিসেবে অভিহিত করেছে। যদিও এর ফলে আগামী দিনে নিগমের উৎপাদন কিছুটা সঙ্কটের মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা অন্য মহলের। সরকার অবশ্য আশঙ্কার বিশেষ ভিত্তি দেখছে না।
নবান্ন-সূত্রের দাবি: রাজ্যের বিদ্যুৎক্ষেত্রে কয়লার জোগান সুনিশ্চিত করতে মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে কোল ইন্ডিয়া’র চেয়ারম্যান নরসিংহ রাওয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। জোগান আরও বাড়ানোর জন্য রাজ্যের তরফে কেন্দ্রীয় কয়লা সংস্থাটিকে আর্জি জানানো হয়েছে। ওড়িশার মহানদী কোলফিল্ডসের সস্তার কয়লা যাতে পশ্চিমবঙ্গকে বেশি পরিমাণে দেওয়া হয়, সে ব্যাপারেও কোল ইন্ডিয়া-র সঙ্গে কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
কয়লা আমদানি এ ভাবে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার প্রসঙ্গে উৎপাদন-ব্যয়ে লাগাম টানার যুক্তিই দিচ্ছেন বিদ্যুৎ দফতরের কর্তারা।
তাঁদের দাবি: উৎপাদনে বিদেশি কয়লা না-লাগালে বিদ্যুতের মাসুল অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। কারণ, ভিনদেশি কয়লার গুণগত মান ভাল হলেও (অল্প কয়লা জ্বালিয়ে বেশি তাপ, ছাইও কম) দেশি কয়লার তুলনায় দাম যথেষ্ট চড়া। কোল ইন্ডিয়া-র এক টন কয়লা কিনতে যেখানে গড়ে দু’হাজার টাকা পড়ে, সেখানে বিদেশি কয়লা অন্তত ছ’হাজার। অর্থাৎ, ফি টনে চার হাজার টাকা বেশি। আর জ্বালানির খরচ বাড়লে তার বোঝা আখেরে গ্রাহকের উপরেই চাপে, মাসুলের চেহারায়। বিদ্যুৎ-কর্তাদের হিসেবে, বিদেশি কয়লা না-কিনলে জ্বালানি খাতে নিগমের বছরে অন্তত ছ’শো-সাতশো কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। মাসুলেও রাশ পরানো যাবে। রাজ্যের বিদ্যুৎ-সচিব গোপালকৃষ্ণের কথায়, “বিদ্যুৎ-মাসুল নিয়ন্ত্রণে রাখাটা রাজ্য সরকারের নীতি। তারই প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত।”
এবং সচিবের দাবি, কয়লা আমদানি না-করলেও রাজ্যের নিজস্ব তাপ-বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমস্যা হবে না। দফতর-সূত্রের খবর, কেন্দ্র সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডে পাচোয়াড়া (উত্তর) ও বীরভূমে দেওচাপাঁচামি নামে দু’টো নতুন খনি পশ্চিমবঙ্গের জন্য বরাদ্দ করেছে। সেখানে উত্তোলন শুরু হলে টানাটানি থাকবে না। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি হিসেবে সস্তার দেশি কয়লা কি উন্নতমানের বিদেশি কয়লার যোগ্য বিকল্প হতে পারে?
দফতর-সূত্রের ব্যাখ্যা: কোল ইন্ডিয়া’র কয়লার তুলনায় বিদেশি কয়লা মানের বিচারে উন্নত ঠিকই। তবে রাজ্যের তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এমন ভাবে বানানো, যাতে নিম্ন বা মধ্যমানের কয়লা দিয়েও ভাল উৎপাদন সম্ভব। “গুণগত মানের খাতিরে নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে যাতে কয়লার অভাব না হয়, সে জন্যই আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করছিলাম।” বলেন এক বিদ্যুৎ-কর্তা। দফতরের তথ্য অনুযায়ী, কোলাঘাট, ব্যান্ডেল, বক্রেশ্বর, সাঁওতালডিহি ও সাগরদিঘি পাঁচ তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র মিলিয়ে নিগমের দৈনিক গড় উৎপাদন ক্ষমতা মোটামুটি ৩ হাজার মেগাওয়াট। এ জন্য বছরে গড়ে দু’কোটি টনের মতো কয়লা লাগে। কোল ইন্ডিয়া দেয় দেড় কোটি টন। ২০ লক্ষ টন আসে নিগমের খনি থেকে। এর পরেও যা প্রয়োজন, গত ক’বছর তার সিংহভাগ বিদেশ থেকে আসছিল। এই অর্থবর্ষে নিগমের ১০ লক্ষ টন বিদেশি কয়লা কেনার কথা, যার অনেকটা ইতিমধ্যে চলে এসেছে।
আগামী বছরে ওই আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তেই রাজ্যের বিদ্যুৎ-শিল্পমহলের একটি অংশ অশনি সঙ্কেত দেখছে। কেন?
এই মহলের বক্তব্য: কোল ইন্ডিয়া এমনিতেই কখনও কখনও সময়মতো কয়লা জুগিয়ে উঠতে পারে না। গ্রীষ্মে সঙ্কট দেখা দেয়। গরমকালের বাড়তি বিদ্যুৎ চাহিদা সামাল দিতে বাড়তি উৎপাদন করতে হয়, যার জন্য অতিরিক্ত কয়লার দরকার পড়ে। অথচ তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাড়তি চাহিদা সামালানোর জন্য কোল ইন্ডিয়া’র কয়লা উৎপাদন যে হারে বৃদ্ধি পাওয়া দরকার ছিল, তা হয়নি। এই কারণে কোল ইন্ডিয়া নিজেও এখন কয়লা আমদানির কথা ভাবছে। এই মহলের ধারণা, আমদানি বন্ধ করে ওই ঘাটতি পূরণের জন্য কোল ইন্ডিয়ার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে নিগম সমস্যায় পড়তে পারে। উপরন্তু নিগমের নিজস্ব খনিতেও উৎপাদন সে ভাবে বাড়েনি।
তা হলে সুরাহা কী হতে পারত?
বিদ্যুৎ-শিল্পের এই মহলটির সূত্রের কথায়, “আমদানি রদ না-করে বিশ্ববাজারে আগাম দরপত্র চেয়ে রাখা যেত। প্রয়োজন হলে কেনা হত। এতে জরুরি পরিস্থিতি দেখা দিলেও ঘাটতির তেমন আশঙ্কা থাকত না। দ্রুত বিদেশি কয়লা এনে কাজ চালানো সম্ভব হত।” দফতরের কর্তারা বলছেন, কয়লার অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হলে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ কিনে পরিস্থিতি সামলানো হবে। যা শুনে সূত্রটির মন্তব্য, “বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লে গ্রিডে বিদ্যুতের ইউনিটপিছু দরও বেড়ে যায়। অনেক সময়ে বেশি দাম দিয়েও তা পাওয়া যায় না।”
কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মোট কয়লার ৮২% উৎপাদন করে কোল ইন্ডিয়া। বিদ্যুৎ-শিল্পমহলের দাবি, কয়লার জোগান অব্যাহত রাখতে দেশের অধিকাংশ তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র আংশিক ভাবে আমদানির উপরে নির্ভরশীল। দেশের বিদ্যুৎ-শিল্পে ফি বছর কয়লার চাহিদা বাড়ছে ৭% হারে। পরামর্শদাতা সংস্থার হিসেব মোতাবেক, ২০১৪-র মধ্যে বিদ্যুৎ-শিল্পে বার্ষিক কয়লা আমদানির বহর দাঁড়াবে অন্তত ১৮ কোটি টন। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গত পাঁচ বছরে আমদানিকৃত কয়লার দামও টনপিছু ২০০% চড়ে গিয়েছে। আমদানি কমালে স্বভাবতই খরচ কমবে। অন্য দিকে চাহিদার সঙ্গে জোগানে তাল রাখা রাখা যাবে কি না, সেটাও প্রশ্ন। নিগমের সিদ্ধান্ত কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে, আগামী বছরটাই বলে দেবে। |