সিনেমা সবে ক্লাইম্যাক্স ছুঁয়েছে।
হঠাৎ ধপাস! চমকে ঘুরে দেখেন, পাশের আসনের দর্শক চেয়ার ভেঙে মেঝেয় গড়াগড়ি দিচ্ছেন।
এ তো শুধু পতন নয়, মোক্ষম সময়ে ছন্দপতন। যেমন রসভঙ্গ হঠাৎ আসনের নীচ দিয়ে পা ভিজিয়ে বয়ে যাওয়া জলে। কী? না, সিনেমা হল লাগোয়া টয়লেট ধোয়ানো হচ্ছে। চৌকাঠ উপচে তা-ই... রাজ্য জোড়া মল-মাল্টিপ্লেক্সের বাজারে যে ক’টি সাধারণ প্রেক্ষাগৃহ এখনও ধুনি জ্বেলে রেখেছে, তার বেশির ভাগেই এ রকম সব ছিটকে দেওয়া, ভাসিয়ে দেওয়া অভিজ্ঞতা অবশ্য প্রাপ্তি। নুন-ম্যাটিনি-ইভনিং শোয়ে চেয়ারে-চেয়ারে ছারপোকাদের লাঞ্চ-টি-ডিনারের বৃত্তান্ত না হয় বাদই দেওয়া গেল।
ইদানীং ১৫ কোটি টাকা খরচ করে বাংলা ছবি হচ্ছে। ছবি রিলিজ হচ্ছে এক সঙ্গে প্রায় আড়াইশো হলে (মাল্টিপ্লেক্স-সহ)। কিন্তু তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সিনেমা হলের হাল ফেরেনি। হল মালিকেরা চাইছেন, রাজ্য সরকার সহজ ভর্তুকির ব্যবস্থা করে সরাসরি তাঁদের পাশে দাঁড়াক।
এমনিতেই এ রাজ্যে সাধারণ প্রেক্ষাগৃহের সিংহভাগ ইতিমধ্যে ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে। দেড় হাজারের মধ্যে টিকে আছে মোটে শ’তিনেক। সিনেমা শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের বক্তব্য: এখন যে মানের বাংলা ছবি হচ্ছে, তার প্রতি দর্শকদের আগ্রহ বেড়েছে। সিনেমা হলের কলি ফেরানো হলে বাড়তি দর্শক টানা সম্ভব। তাতে আখেরে লাভ টলিউডেরই। কিন্তু হল মালিকেরা বলছেন, দৈনন্দিন খরচ চালিয়ে প্রেক্ষাগৃহ সংস্কারের জন্য যথেষ্ট টাকা তাঁদের হাতে থাকে না। আগে যে হারে ভর্তুকি মিলত, তা কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়েছে।
রাজ্যের প্রেক্ষাগৃহগুলি সংস্কারের জন্য ২০০০ সাল থেকে ভর্তুকি চালু করেছিল তদানীন্তন বাম সরকার। নিয়ম হল, কোনও হল মালিক সংস্কারের জন্য যত খরচ করবেন, পরের দু’বছর সরকারকে দেওয়ার প্রমোদ কর থেকে সেই অঙ্কের ছাড় পাবেন। অধিকাংশ মালিক কিন্তু তা নেননি। তাঁদের অভিযোগ, টাকা খরচ করে ফেলার পরে ভর্তুুকির টাকা হাতে পেতে জুতোর সুকতলা খয়ে যায়। প্রথমে জেলা প্রশাসনের কাছে প্রকল্প জমা দিতে হয়। সেখান থেকে তা যায় অর্থ দফতরে। তারা অনুমোদন দিলেই টাকা মেলে। কিন্তু সেই টাকা পাওয়া যে কত জটিল এবং কঠিন, তা ভুক্তভোগীই জানেন।
হাওড়ার বাগনানের এক হল মালিক জানান, ডলবি সাউন্ড সিস্টেম বসানো-সহ নানা ধরনের সংস্কারের পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। দেড় বছর জেলা প্রশাসন ও অর্থ দফতরে ঘোরাঘুরি করে প্রকল্পটি অনুমোদনও করান। তাঁকে জানানো হয়, কাজ করতে হবে কয়েকটি পর্যায়ে। প্রতিটি পর্যায়ের শেষে জেলা প্রশাসনের আধিকারিকেরা সরেজমিন পরিদর্শন করে শংসাপত্র দিলে তবেই সেই পরিমাণ টাকা ভর্তুুকি পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবে। ওই হল মালিকের কথায়, “নিজের টাকা খরচ করে ফেলার পরে যদি শংসাপত্র না-পাই এই আশঙ্কায় রণে ভঙ্গ দিলাম।”
সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুরের এক হলে। সেটির মালিকের বক্তব্য, “প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে কয়েক লক্ষ টাকার কাজ করিয়েছিলাম। কিন্তু আধিকারিকেরা এসে জানালেন, আমি ভর্তুুকির টাকা পাব না। কারণ, ঠিকাদারদের পাওনা মিটিয়েছি নগদে। সেটা চেকে দেওয়ার কথা। তা যে নিয়ম নয়, সেটাই তো আগে আমায় কেউ জানাননি।”
এর থেকেও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ২০১০ সাল থেকে ভর্তুকির পরিমাণ কমে যাওয়া। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরের এক মালিক জানান, তাঁর প্রকল্প যখন অনুমোদিত হয় তখন বাংলা ছবির ক্ষেত্রে প্রমোদ কর ছিল টিকিটের দামের ১০%। কিন্তু হল সংস্কারের কাজ শেষ হতে না-হতেই, তদানীন্তন বাম সরকার প্রমোদ কর কমিয়ে ২% করে দেয়। সেই সঙ্গে ভর্তুকির পরিমাণও এক ধাক্কায় ৮০ শতাংশ কমে যায়। মাথায় হাত পড়ে হল মালিকের।
ইন্ডিয়ান অ্যান্ড ইস্টার্ন মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ইমপা) মতে, প্রেক্ষাগৃহ সংস্কার করে এখনও হল-নির্ভর সিনেমা শিল্পকে বাঁচানো যায়। কিন্তু তার জন্য বেশি সময় ধরে পর্যাপ্ত ভর্তুকি পাওয়া প্রয়োজন। ইমপা-র প্রদর্শন শাখার পক্ষে পুলক মুখোপাধ্যায় বলেন, “কলকাতা এবং জেলাগুলিতে কয়েক জন বড় হল মালিক নিজেদের টাকায় প্রেক্ষাগৃহ সংস্কার করেছেন। তাঁদের হলে বেশি দর্শক আসছেন। বিগত বাম সরকার ভর্তুকি প্রথা চালু করলেও পরে তা কমিয়ে দেয়। ছোট ও মাঝারি হল সংস্কারের কথা তারা চিন্তাই করেনি।” তাঁদের দাবি, প্রমোদ করের মাধ্যমে যদি ভর্তুকির টাকা উসুল করতেই হয়, তবে ছাড়ের মেয়াদ দু’বছর থেকে অনেক বেশি বাড়ানো হোক।
রাজ্যে যিনি চলচ্চিত্রের বিষয়টি দেখেন, সেই আবাসন ও যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী চান, বাংলা চলচ্চিত্রের সব শাখাতেই উন্নতি হোক। হল মালিকেরা লিখিত ভাবে আমাদের প্রস্তাব দিলে, সরকার তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে।” দেখা যাক, পর্দায় শেষে ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ ফুটে ওঠে কি না...। |