গুগবাসিনী তলা। গ্রামের ওই প্রাণকেন্দ্রে বিকেল থেকেই মাইকে চলছে ঘোষণা “আর কিছু ক্ষণের মধ্যেই শুরু হতে চলেছে, অশ্রুসজল সামাজিক যাত্রাপালা ‘মা বিক্রির মামলা।” প্রতি বছরের মতো নবান্ন উৎসবকে ঘিরে সম্প্রতি রামপুরহাটের গুগ গ্রামে ফের দেখা গেল এই দৃশ্য। অগ্রহায়ণ মাসের এই উৎসবের জন্য ওই গ্রামের মানুষের এই আবেগ শতাব্দী প্রাচীন। পুরনো দিনের মতোই নতুন প্রজন্মের কাছেও ওই আবেগ আজও সমান বর্তমান।
গ্রামের প্রবীণ যাত্রাশিল্পী শিবশঙ্কর মণ্ডল, অশোক মণ্ডল, বঙ্কিমবিহারী রায়রা জানান, এ ক’টা দিন সব কাজ ফেলে এলাকার মানুষ কৃষক থেকে শ্রমজীবি, চাকুরীজীবি সকলেই সমান মশগুল হন। আগে গ্রামের কয়েক জনের বাড়ি থেকে বড় বড় চৌকি এনে যাত্রার স্টেজ তৈরি করা হত। বর্তমানে গ্রামের ঐতিহ্যকে সম্মান জানাতে বিধায়ক এলাকা উন্নয়ন তহবিল থেকে পাকা সাংস্কৃতিক মঞ্চ গড়ে উঠেছে। সেখানেই এখন যাত্রা হয়। তিন প্রবীণেরই আক্ষেপ, “আগে পৌরাণিক পালা, ধর্মীয় পালা, ঐতিহাসিক পালা বেশি অভিনীত হত। এখনকার দর্শক সামাজিক যাত্রাপালাই বেশি পছন্দ করেন।” বর্তমান সময় চাহিদা অনুযায়ী চলতে গিয়ে পুরনো অনেক কিছুই বাদ পড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা তাঁদের চোখেমুখে। তবে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও যে শতাব্দী প্রাচীন এই উৎসবকে চালিয়ে যাচ্ছেন, তাতে তাঁরাআশার আলোয় দেখছেন। এ বারও যাত্রা উপলক্ষে গোটা গ্রামই মেতে উঠেছিল। মাইকে ঘোষণার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এলাকার যাত্রাপ্রিয় মানুষও বিকেল থেকেই সেই গুগবাসিনী তলার দিকে মাদুর, চট, চাটাই, ছেঁড়া ত্রিপল নিয়ে হৈ হৈ করে ছুটেছেন। আগে গিয়ে পছন্দ মতো জায়গা দখল করেছেন। গ্রামের কচিকাঁচাদের সঙ্গেই বড়রাও উঁকি মেরেছেন যাত্রাশিল্পীদের সাজঘরে।
তবে, আগে টানা চার দিন ধরে যাত্রা উৎসব হলেও বছর তিনেক হল, তা দু’দিন ধরে করা হচ্ছে। এখন যাত্রা হয় গ্রামেরই নবীন যাত্রাশিল্পী প্রসেনজিৎ মণ্ডলের পরিচালনায়। তিনি বলছেন, “টিভির সিরিয়াল এখন গ্রামের যাত্রাপ্রিয় দর্শকের মন কেড়ে নিয়েছে। তাই চার দিনই যাত্রাপালার আয়োজন করলে দর্শক মিলবে না। এ ছাড়া পৌরাণিক-ঐতিহাসিক বা ধর্মীয় পালা প্রযোজনায় খরচ অনেক বেশি। তাই দর্শকদের চাহিদা মেনে আমরা সামাজিক পালাই বেশি আয়োজন করি।” গুগ গ্রামে প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে মানুষ নবান্ন পালন করেছেন। এ বছর দু’দিন যাত্রাপালা হয়েছে। অন্য দু’দিন হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আগে ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যাত্রাপালায় অভিনয় করতেন গ্রামেরই নূপুর মণ্ডল, বাসন্তী পালরা। নবান্ন উৎসবের সময় গ্রামের যাত্রাপালা দেখতে শ্বশুরবাড়ি থেকে ঠিক ছুটে আসেন। যাত্রা দেখতে দেখতে পুরনো স্মৃতিভারে তাঁদের অনেকেরই চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। |