আত্মঘাতী বিমান আছড়ে পড়ল শহরটাতে। ধীরে ধীরে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নিচ্ছে। মানুষের আর্তনাদে ভরে গিয়েছে নিউ ইয়র্কের আকাশ বাতাস। তবে এটা ৯/১১-র কথা নয়। বরং সেই সময়ের প্রায় ৫৬ বছর আগেই জার্মানির বাঙ্কারে বসে শত্রুদেশ আমেরিকা ধ্বংসের এমন পরিকল্পনা করেছিলেন অ্যাডলফ হিটলার।
হিটলারের অস্ত্রমন্ত্রী অ্যালবার্ট স্পিয়ার তাঁর ডায়েরিতে লিখে গিয়েছেন, কী ভাবে শত্রুপক্ষকে ধ্বংস করা যায় তা নিয়ে নানা চিন্তা ভাবনা করতেন ফ্যুয়েরার। সম্প্রতি হিটলারের উপরে তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে স্পিয়ারের ডায়েরি-সহ এমন বেশ কিছু তথ্য খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। যার সঙ্গে অবিশ্বাস্য মিল রয়েছে ৯/১১-য় আল কায়দার হাতে আমেরিকার টুইন টাওয়ারের ধ্বংসলীলার। যার ষড়যন্ত্রীদের তখনও জন্মও হয়নি।
বিশ্ব জুড়ে আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখা হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই বিভিন্ন আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র তৈরির উপরে জোর দিতে থাকেন। নথি ঘেঁটে জানা যাচ্ছে, এক-দু’ বার নয় অন্তত পাঁচ বার আমেরিকায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন হিটলার।
সময়টা ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি। প্রথম বার আত্মঘাতী পরিকল্পনার কথা সামনে এল। এই পরিকল্পনার কথা জানতে পারল মিত্রশক্তিও। প্রবল আক্রমণ শুরু করল মিত্রশক্তি। বাধ্য হয়ে অস্ট্রিয়ায় এক পাহাড়ের তলার ৬০ ফুট গভীর ঘর বানানো হল। সেখানেই চলল আত্মঘাতী বোমারু বিমান তৈরির কাজ। বোমা সমেত যুদ্ধবিমানগুলো আঘাত হানার আগেই প্যারাসুটে করে বিমান থেকে ঝাঁপ দেবেন বিমান চালক। এ দিকে ঠিক সেই সময়েই ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ব্রিটেন আর আমেরিকাও একই ভাবে শত্রুপক্ষের উপর আত্মঘাতী হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছিল। কিন্তু কোনও বারই সফল হয়নি তারা। এ দিকে জার্মানির তৈরি আত্মঘাতী বোমারু বিমান ‘কনডোর’ খুব ভারী আর ধীরে চলে। বাতিল হল ধারণাটা।
তবে দমলেন না হিটলার। ১৯৪৫ সালের প্রথম দিক। ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে জার্মানি। এ বার ঠিক হল একটা বড় বিমানের পেটে পাঁচটা ছোট আত্মঘাতী যুদ্ধবিমান থাকবে। নির্দিষ্ট জায়গায় সোজা আঘাত হানবে তারা। এ বার আর প্যারাসুটে করে পালাবে না চালকরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। রাশিয়ার আক্রমণে হার স্বীকার করতে বাধ্য হল জার্মানি।
আমেরিকা হানার পরিকল্পনা অবশ্য শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। ১৯৩৭ সালে উইলি মেসারস্মিথ যখন যা বহু দূরে আর অনেক বেশি বোমা নিয়ে যেতে পারবে এমন এক যুদ্ধ বিমানের পরিকল্পনা করেন, তখনই হিটলারের মাথায় নতুন চিন্তা খেলে যায়। শত্রুপক্ষকে ধ্বংস করতে এর থেকে ভাল অস্ত্র আর কিছু হয় না। গবেষণাগারে শুরু হল চার ইঞ্জিনের এমই-২৬৪ তৈরির কাজ। ১৯৩৯ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু। প্রথম দিকে নিরপেক্ষই ছিল আমেরিকা। হিটলার এক রকম নিশ্চিত ছিলেন, মিত্রশক্তিতে যোগ দেওয়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির হাতে পর্যদুস্ত হবেই। তা হলে বাকি রইল দু’টো বড় শক্তি। আমেরিকা আর জার্মানি। বিশ্বে নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে গেলে হারাতেই হবে আমেরিকাকে।
ঠিক হল বোমা ভরে টানা নিউ ইয়র্ক উড়ে যাবে এমই-২৬৪। নিউ ইয়র্কের বুকে বোমা ফেলে ফের জার্মানি উড়ে আসবে সে। কিন্তু টানা এত দূর কোনও বিমান উড়তে পারবে না। তাই আইসল্যান্ড দখল করার পরিকল্পনা করলেন ফ্যুয়েরার। জার্মানি আর আমেরিকার ঠিক মাঝামাঝি এই দেশেই ওড়ার মাঝে জ্বালানি ভরবে এমই-২৬৪। ১৯৪১ সালে আইসল্যান্ডের দখল নিল আমেরিকা। এর পরেই ঐতিহাসিক পার্ল হারবার আক্রমণ। মিত্র শক্তিতে যোগ দিল আমেরিকা। প্রকাশ্যেই আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল জার্মানি।
১৯৪২ সালের মে মাস। চার জন নাৎসি কম্যান্ডো ডুবোজাহাজে দীর্ঘ পাড়ি দিয়ে উঠলেন নিউ ইয়র্কে। হাতে সুটকেস। ভর্তি ডিনামাইট। লক্ষ্য নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন জনবহুল স্থানে বিস্ফোরণ ঘটানো। এক উপকূলরক্ষী দেখে নিয়েছিলেন তাঁদের। খবর গেল এফবিআইয়ের কাছে। শুরু হল চিরুনি তল্লাশি। উপায় না দেখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন ওই চার কম্যান্ডো। তবে এফবিআইয়ের তরফে জানানো হল, মার্কিন অস্ত্রাগারে হামলা চালাতেই এসেছিল নাৎসিরা। যাতে আতঙ্ক না ছড়ায়, গোপন করা হল তাঁদের আসল উদ্দেশ্য।
১৯৪৪-এর শেষ। তৈরি হল এমই-২৬৪। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির জেরে ভাল করে উড়তেই পারল না সেটি। পরপর দু’টো পরিকল্পনা ভেস্তে গেলেও দমলেন না ফ্যুয়েরার। এ বার আসরে এলেন কর্নেল ভিক্টর ভন লসবার্গ। তাঁর পরিকল্পনা ছিল, একটা বিমানকে অতলান্তিকের মাঝপথে নামানো হবে। সেখানে অপেক্ষা করবে ডুবোজাহাজ। ডুবোজাহাজে জ্বালানি ভরে বিমানটি ফের উড়ে যাবে নিউ ইয়র্কে। ঘটাবে বিস্ফোরণ। কিন্তু তখন শীতকাল। আবহাওয়া খুব খারাপ। ঠিক হল, ১৯৪৪ সালের বসন্তে এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হবে। কিন্তু এ বারেও বাদ সাধল সেই আমেরিকাই। অতলান্তিক থেকে জার্মানির ডুবোজাহাজগুলোকে হটিয়ে দিল মার্কিন যুদ্ধজাহাজ। এই পরিকল্পনাটাও বাতিল হয়ে গেল।
স্পিয়ারের লেখায়, ফ্যুয়েরার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে গিয়েছেন জার্মানি হারাবে আমেরিকাকে। আত্মঘাতী বোমারু বিমানের আঘাতে ধ্বংস হবে আমেরিকা। হামলার স্বপ্ন তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৫৬ বছর পরে পূরণ হয়েছিল ওসামা বিন লাদেনের আল কায়দার হাত ধরে। |