ফিরলেন মাদিবা। এ বার পাকাপাকি ভাবে। আর কখনও কোনও লড়াইয়ের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে গ্রাম ছাড়বেন না তিনি। এখন থেকে কুনুর নিরাপদ গর্ভে শুধুই শান্তির ঘুম।
দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্টার্ন কেপ প্রদেশের এই প্রত্যন্ত গ্রামেই সমাহিত করা হয়েছিল নেলসন ম্যান্ডেলার তিন সন্তানকে। ঐতিহ্য মেনে রবিবার তিন সন্তানের পাশে সমাহিত করা হয় ৯৫ বছরের ‘টাটা’কে। সাক্ষী প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষ। বেশিরভাগই কুনুর বাসিন্দা। ছিলেন ব্রিটেনের যুবরাজ চার্লস, ওপরা উইনফ্রে, ব্যবসায়ী রিচার্ড ব্র্যানসনের মতো তারকা ব্যক্তিত্বরাও। কারও চোখে জল, কারও বা কণ্ঠে গান। কেউ আবার নাচলেন। ম্যান্ডেলার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে এ ভাবেই স্মরণ করেছেন বাসিন্দারা। সে রেশ বজায় থাকল শেষ দিনেও।
ম্যান্ডেলা-স্মরণে এ দিনও শেষকৃত্যের আগে একটি অনুষ্ঠান করা হয়। গ্রামের যে অংশে জমি রয়েছে ম্যান্ডেলা-পরিবারের, সেখানে টাঙানো হয় দৈত্যাকার কালো তাঁবু। তার ভিতরে হাজির ছিলেন সাড়ে চার হাজার মানুষ। মঞ্চে মাদিবার ছবি। মাইকের সামনে কখনও প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা, কখনও শাসক দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাপোঝা, কখনও বা রবেন আইল্যান্ডে ম্যান্ডেলার কারাসঙ্গী তথা বন্ধু ভারতীয় বংশোদ্ভূত আহমেদ কাথ্রাডা। বয়স, ক্ষমতা, পদমর্যাদা, সম্পর্ক সব কিছু নির্বিশেষে প্রত্যেকেই বিহ্বল। আহমেদ যেমন বলে ফেললেন, “আমার ভাইকে হারালাম। জীবনে এখন শুধুই শূন্যতা।” দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত প্রেসিডেন্ট জুমাও অকপট, “পঁচানব্বই বছর আগে যে অবিশ্বাস্য যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার শেষ এখানেই।” সামনে তখন জাতীয় পতাকার চাদরে মোড়া ম্যান্ডেলার কফিন। জ্বলছে পঁচানব্বইটি মোমবাতি। ম্যান্ডেলার পঁচানব্বই বছরের জীবনকে উৎসর্গ। বক্তৃতা আর মোমবাতির শিখায় বিহ্বল জনতার অনেকেই চোখ মুছছেন। |
বেদনার মুহূর্ত
ছেলেবেলার গ্রাম কুনুতে রবিবার অনুষ্ঠিত হল নেলসন ম্যান্ডেলার শেষকৃত্য।
হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী উইনিও। ছবি: এএফপি। |
অনুষ্ঠান শেষ হলে কফিন নিয়ে সমাধিস্থলের দিকে রওনা হয় সেনাবাহিনী। পিছু নেয় জনতা। কারও পরনে কালো স্যুট, থেম্বু গোষ্ঠীর(এই গোষ্ঠীরই সদস্য ছিলেন ম্যান্ডেলা) নিয়ম মেনে কারও বা গায়ে পশুর চামড়া। তবে প্রত্যেকেরই বুকে হাত, কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত। আকাশে তখন চক্কর খাচ্ছে খানতিনেক সেনা হেলিকপ্টার। তাদের প্রত্যেকের পেটেই বাঁধা জাতীয় পতাকা। দক্ষিণ আফ্রিকাকে স্বাধীনতার অর্থ বুঝিয়েছিলেন কুনুর যে বাসিন্দাটি, আজ তাঁরই শেষযাত্রায় উড়ছে জাতীয় পতাকা। সঙ্গতে ২১টি তোপধ্বনি, পূর্ণ সেনা সম্মান। দেখলেন ম্যান্ডেলার তৃতীয়া স্ত্রী গ্র্যাকা মিশেল। চোখটা ছলছল করে উঠল। কিছুটা যেন সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতেই তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন উইনি ম্যান্ডেলা, মাদিবার দ্বিতীয়া স্ত্রী। সেনাবাহিনীর কাঁধে কফিনবন্দি হয়ে ম্যান্ডেলা তখন চলেছেন তাঁর শেষ গন্তব্যের দিকে।
একটা সময়ে শেষ হল সেই যাত্রাও। সূর্য তখন মধ্যগগনে। গোষ্ঠীর নিয়ম মাফিক এ সময়ই সমাহিত করা উচিত ম্যান্ডেলাকে। হলও তাই। শুধু তা-ই নয়, গোষ্ঠীরই আচার মেনে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ম্যান্ডেলার সঙ্গে কথা বলে গেলেন সকলে। মৃত্যুর পরে যাতে তাঁর আত্মা একা না হয়ে পড়ে, সে জন্য প্রথামাথিক ষাঁড়ের বলিও দিলেন সকলে। কুনুর নিয়ম অনুযায়ী, মৃত ষাঁড়ের রক্ত অতিথিদের সবাইকে খাওয়ানোর কথা। সেটা হল কি না, তা অবশ্য জানার উপায় নেই। কারণ শেষের মুহূর্তগুলো পরিবারের অনুরোধ মেনেই সম্প্রচার করেনি সংবাদমাধ্যম। পর্দায় গোটা সফরটা দেখলেও মাদিবার শেষের মুহূর্তটা তাই দেখতে পেল না বিশ্ব।
কিন্তু তাতে কী? যাঁর অসামান্য জীবনটার গোটাটাই দেখেছে বিশ্ব, তাঁর শেষকৃত্যের অন্তিম মুহূর্তগুলো না-ই বা ধরা পড়ল চোখে। তাঁর তৈরি ইতিহাসটা তো থাকছেই। আর তার উত্তরাধিকার? সেটা রাখার জন্যও আপ্রাণ লড়বে দক্ষিণ আফ্রিকা।
ম্যান্ডেলা না হয় এ বার শান্তিতে থাকুন, কুনুর গর্ভে। |