টান টান স্কার্ফে কপালটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ছোট্ট মেয়েটির। খাটো ঘোড়ায় চড়ে উইন্ডামেয়্যার হোটেলের লাগোয়া পার্কের চার পাশে নাগাড়ে চক্কর কেটে চলেছে সে, “...আমি ঘোড়ায় চ-ড়-ছি, আবার চড়ব।”
‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। ষাটের দশকের গোড়ায় সত্যজিৎ রায়ের প্রথম রঙিন ছবির সেই দৃশ্যেই আমরা খোঁজ পেয়েছিলাম, পাহাড়ি শহরটার সঙ্গে কী নিবিঢ় সম্পর্কে জড়িয়ে রয়েছে পর্যটন-প্রিয় ঘোড়ারা। দার্জিলিঙের ম্যাল আর আর তাকে ঘিরে ছড়িয়ে থাকা অজস্র পনি বা লোমশ খুদে ঘোড়ার পিঠে চড়ে পর্যটকদের ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো অতঃপর ধরা পড়তে থাকে মুম্বই কিংবা টালিগঞ্জের একের পর এক ছবিতে। ‘লালকুঠী’ থেকে হালের ‘বরফি’, ফিরে ফিরে এসেছে দার্জিলিঙের পরিচিত ‘টাট্টু-কুল’।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দার্জিলিঙে এসে কেভেন্টার, গ্লেনারিজের কফি-চকোলেট, টাইগার হিলের সূর্যোদয় কিংবা বাতাসিয়া লুপের টয়-ট্রেনের হুল্লোড়ের পাশাপাশি পর্যটকদের কাছে ঘোড়ায় চড়ার রোমাঞ্চও কম ছিল না।
কিন্তু, ‘রুচি’তে টান পড়েছে। কেন? |
টাট্টু ঘোড়া সংগঠনের সভাপতি শমসের তামাঙ্গ বললেন, “ম্যালের সঙ্গে ঘোড়ার তো প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। অথচ বছর কয়েক ধরে দেখছি, পর্যটকেরা আর ঘোড়ায় চড়তে চাইছেন না। মানুষের রুচিটাই বদলে গিয়েছে!”
শমসের তামাঙ্গ জানান, শহরে পর্যটকদের জন্য এখন মেরেকেটে গোটা ত্রিশেক ঘোড়া রয়েছে। অথচ বছর পাঁচেক আগেও অন্তত ৭০-৮০’টা ঘোড়া প্রায় সব সময় দাঁড়িয়ে থাকত ম্যালের এ দিক সে দিকে। কোথায় গেল তারা? শমসের বলেন, “চাহিদা না থাকলে যা হয়, তাদের অনেকেই এখন ভাড়া খাটে পাহাড়ের এ দিক ও দিক।”
ম্যালে অন্তত গোটা তিনেক ঘোড়া ভাড়া খাটাতেন স্থানীয় এক বাসিন্দা। তাঁর ব্যাখ্যা, “পর্যটকদের ঘোড়া-বিমুখ হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় ছেলেরাও আর এই ব্যবসায় আসতে চাইছেন না।” বংশপরম্পরায় চলে আসা এই ব্যবসায় রয়েছেন এমন বেশ কয়েকটি পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, সামান্য আয়ের এই ‘একঘেয়ে’ কাজে আর আগ্রহ পাচ্ছেন না হালের যুবারা। তাঁদেরই এক জন স্পষ্ট বলেন, “টাট্টুর লাগাম ধরে পর্যটকদের দিন ভর ঘুরিয়ে কী এমন আয় হয়? তা ছাড়া কাজটাও খুব ক্লান্তিকর।”
স্থানীয় ঘোড়া ব্যবসায়ীরা জানান, ম্যালের রাস্তায় এক ঘণ্টার পাক চারশো টাকা, ম্যালে এক চক্কর খেতে ২০০ টাকা, ‘হাফ’ বা অর্ধেক রাস্তা একশো টাকা আর চৌরাস্তায় পাক খেতে সাকুল্যে ৫০ টাকা। এই হল ভাড়া। দিনভর ঘুরে তাঁদের আয় তাই চার থেকে পাঁচশো টাকাতেই থমকে থাকে। তবে ভরা পর্যটন মরসুমে অবশ্য হাজার দুয়েক টাকা আয় হয় তাঁদের। তার মধ্যে অবশ্য ঘোড়ার খাওয়া খরচ আর রোগ বালাইয়ের খোরাকি বাবদ শ’দুয়েক টাকা বেরিয়ে যায়।
চৌরাস্তার ধারেই দার্জিলিঙের ঘোড়া রাখার আস্তাবল। সেখানে ঘোড়া রাখার জন্য বছরে ৬৫০ টাকা গুনতে হয় মালিকদের। তবে অস্বাস্থ্যকর সেই আস্তাবলের অবস্থা ভাল নয় বলেই জানিয়েছেন ঘোড়া-মালিকেরা। ম্যাল থেকে ঢালু পথে ঘরে ফেরার আগে প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে যান স্থানীয় এক ঘোড়া চালক, “এরপরেও ব্যবসা টানা যায়?”
শূন্য ম্যালে মিলিয়ে আসে ঘোড়ার খুরের শব্দ। |