টাকা দেবে কে! এ নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য চাপানউতোরে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প ঘিরে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে চিঠি লিখেছেন। দিল্লি গিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন রাজ্যের সেচ দফতরের কর্তারাও। এমনকী দিল্লি সফরে গিয়ে গোটা বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গে আলোচনা করছেন শাসক দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। তবে কেন্দ্রের তরফে কোনও নির্দিষ্ট আশ্বাস মেলেনি বলে জানা গিয়েছে।
সেচ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, আগের নিয়ম অনুযায়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকার ৭৫ শতাংশ টাকা দিত। বাকি ২৫ শতাংশ টাকা দিতে হত রাজ্যকে। সম্প্রতি নিয়ম পরিবর্তন করেছে কেন্দ্র। স্থির হয়েছে, এখন থেকে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়কেই ৫০ শতাংশ করে টাকা দিতে হবে। এর জেরেই কেন্দ্র-রাজ্য চাপানউতোর শুরু হয়েছে। আর তাতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান, কান্দি মাস্টার প্ল্যান, নিম্ন দামোদর বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প, দ্বারকেশ্বর-গন্ধেশ্বরী বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে।
গত সেপ্টেম্বরে নতুন নিয়ম জেনে সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় জলসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রীকে চিঠি দেন। রাজীববাবু বলেন, “বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে কেন্দ্র এক ধাক্কায় ২৫ শতাংশ বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ায় রাজ্যের সাধারণ মানুষ বিপদে পড়বেন। গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলি আটকে যাবে। কেন্দ্র সরকারের এই বিমাতৃসুলভ আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। মুখ্যমন্ত্রী নিজে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।” মুখ্যমন্ত্রীর দফতর সূত্রের খবর, দলীয় সাংসদের বিষয়টি নিয়ে দিল্লিতে সরব হতে বলেছেন তিনি। দিল্লি সফরে গিয়ে নিজেও বিষয়টি তুলছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কেন্দ্রীয় জলসম্পদ উন্নয়ন দফতর সূত্রে খবর, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পগুলি পটনায় গঙ্গা ফ্ল্যাড কন্ট্রোল কমিশনের মাধ্যমে পাঠাতে হয়। ‘গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশন’-এর ডিরেক্টর রবিভূষণ কুমার বলেন, “প্রকল্পের টেকনিক্যাল দিক খতিয়ে দেখে আমরা তা দিল্লিতে পাঠিয়ে দিই। টাকার বিষয়টি জলসম্পদ মন্ত্রক ঠিক করে।” এ প্রসঙ্গে জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের কমিশনার (গঙ্গা) এন কে মাথুরের বক্তব্য, “কোন প্রকল্পে কত শতাংশ টাকা দেওয়া হবে তা অর্থ মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।”
সেচ দফতর সূত্রে খবর, অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পগুলি ঘিরে অনিশ্চয়তা ঘনিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান। ১৯৮২ সালে তৎকালীন সেচ প্রতিমন্ত্রী প্রভাস রায় শিলাবতী নদীর পাড়ে এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেছিলেন। তারপর তিন দশক কেটে গিয়েছে। কিন্তু কাজ এগোয়নি এতটুকু। বছর দুয়েক আগে প্রকল্পটি নিয়ে ফের তোড়জোর শুরু হয়।
ডিপিআর (ডিটেল প্রজেক্ট রিপোর্ট) তৈরি করে কেন্দ্রীয় সরকার অনুমোদিত একটি সংস্থা। রাজ্য সরকার তা পাঠিয়ে দেয় ‘গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশন’-এ। তবে ডিপিআর-এ কিছু ত্রুটি ধরা পড়ায় তা সেচ দফতরে ফিরে আসে। মাস দুয়েক আগে সংশোধিত ডিপিআর ফের কমিশনে পাঠানো হয়েছে। সেই সঙ্গে বরাদ্দ হয়েছে ১৫৮০ কোটি টাকা।
ডিপিআর তৈরি হয়েছে কান্দি মাস্টার প্ল্যানেও। প্রকল্প ব্যয় ৪২০ কোটি টাকা। সেচ দফতর সূত্রের খবর, এই প্রকল্পে প্রথম পর্যায়ে তিনটি সেতু ও ১২০ কিলোমিটার বাঁধ তৈরি হবে। সেচ দফতরের বহরমপুর বিভাগের আধিকারিক স্বপনকুমার সাহা বলেন, “এখন জমি সমীক্ষার কাজ চলছে।” সেচ দফতর সূত্রে খবর, পুরনো নিয়ম অনুযায়ী ২৫ শতাংশ ব্যয় ধরে ঘাটাল ও কান্দির দু’টি প্রকল্প মিলিয়ে ৫০০ কোটি টাকা বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু নতুন নিয়মে রাজ্যকে ৫০ শতাংশ টাকা দিতে বলায় প্রকল্প দু’টির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
নিম্ন দামোদর বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প, দ্বারকেশ্বর-গন্ধেশ্বরী বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পেও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তবে এই দুই প্রকল্পের ক্ষেত্রে সে ভাবে কাজ শুরু হয়নি। নিম্ন দামোদর বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে শুধু একটি কমিটি গড়া হয়েছিল। আর দ্বারকেশ্বর-গন্ধেশ্বরী বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে এখনও টাকাই আসেনি। এই প্রকল্প দু’টি রূপায়িত হলে বহু মানুষ উপকৃত হবেন। দ্বারকেশ্বর-গন্ধেশ্বরী প্রকল্পের ক্ষেত্রে বাঁকুড়া সদর, বিষ্ণুপুর, জয়পুর, কোতুলপুর ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকায় জলসেচে সুবিধা হবে। সেই সঙ্গে ওন্দা ও কোতুলপুরের গ্রামগুলিতে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
আপাতত সব পরিকল্পনাই টাকা-জটে থমকে। |