তাঁর সরকার কী কী কাজ করেছে, সেই তথ্য গত আড়াই বছরে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার, এক বছরে সরকার কী কী করবে, সেই কর্মসূচিও প্রশাসনিক গণ্ডির মধ্যে আটকে না-রেখে আমজনতার হাতে আগাম পৌঁছে দিতে চাইছেন তিনি। এর ফলে এক দিকে যেমন সরকারি কর্মচারীদের দায়বদ্ধতা নির্দিষ্ট করা যাবে, তেমনই অন্য দিকে সময়ে কাজ শেষ করার জন্য তাঁদের উপরে চাপ বাড়বে বলে মনে করছেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা।
নবান্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, কী কী কাজ করা গিয়েছে তার খতিয়ান প্রকাশ করে এত দিন সরকারের সাফল্যই তুলে ধরা হতো। কিন্তু তার পাশাপাশি সময় ধরে প্রকল্প রূপায়ণেও যে সরকার আন্তরিক, মানুষের কাছে সেই বার্তাই দিতে চাওয়া হচ্ছে। প্রকাশিত কর্মসূচি অনুযায়ী কাজ না হলে স্বাভাবিক ভাবেই জনগণের প্রশ্নের মুখে পড়বেন প্রশাসনিক কর্তারা।
নবান্নের এক কর্তা এ দিন বলেন, “এত দিন বিভিন্ন প্রশাসনিক বৈঠকে অফিসারদের সময় বেঁধে কাজ শেষ করার পরামর্শ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে একাধিক সচিব প্রকল্প সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে অনেক সময় মুখ্যমন্ত্রী সন্তুষ্ট হননি। এমনকী, কাজে ধীর গতির জন্য বকাও খেয়েছেন বেশ কয়েক জন আধিকারিক।” ওই কর্তার মতে, কাজে গতি আনার জন্য তাই আর মৌখিক আশ্বাস নয়, প্রকল্প শেষের ব্যাপারে অফিসারদের লিখিত প্রতিশ্রুতি আদায় করতে চাইছে সরকার। যে ব্যবস্থা দেশের কোথাও নেই বলে ঘনিষ্ঠ মহলে জানান মমতা।
রাজ্য প্রশাসনের একাংশের মতে, সরকারের পাশাপাশি শাসক দলও আমজনতার কাছে দায়বদ্ধ। যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল, তা পূরণ না-হলে মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে তাদেরই। তাই প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার তৈরি করে সরকারি আধিকারিকদেরও পরোক্ষে সেই দায়বদ্ধতায় বাঁধতে চাইছে তারা। ওই কর্তাদের বক্তব্য, প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার তৈরি হয়ে গেলে তা হাতে নিয়েই দফতরের সচিবদের নিয়ে বৈঠক করবেন মুখ্যমন্ত্রী। যদি কোথাও কোনও কাজে দেরি হয়, তা হলে সংশ্লিষ্ট সচিবের লিখিত প্রতিশ্রুতি সামনে রেখে তাঁর কৈফিয়ত তলব করতে পারবেন তিনি। আর সেই আশঙ্কার মুখে সময় ধরে কাজ শেষের ক্ষেত্রে আমলারা আরও সক্রিয় হবেন বলেই মনে করছেন নবান্নের একাধিক কর্তা।
মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার যে কোনও ঢিলেমি বরদাস্ত করবে না, জনপরিষেবা আইন চালু করে তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “নানা অজুহাতে কাজ ফেলে রাখলে অভিযুক্ত সরকারি কর্মীর জরিমানার বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে ওই আইনে। জরিমানার পরিমাণ আড়াইশো থেকে এক হাজার টাকা। সে কথা সংশ্লিষ্ট কর্মীর সার্ভিস বুক-এ লেখাও থাকবে।” তবে কর্মীদের কেবল শাস্তি দেওয়াই যে প্রশাসনের উদ্দেশ্য নয়, তাঁদের ভাল কাজও যে সরকার অন্য চোখে দেখবে তারও বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে জনপরিষেবা আইনে। বলা হয়েছে, ভাল কাজের পুরস্কার এক হাজার টাকা, সঙ্গে শংসাপত্র, যার উল্লেখ থাকবে সার্ভিস বুকেও।
রাজ্য প্রশাসনের একাংশের মতে, প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার আদতে ‘জনতা দরবার’-এরই আর এক রূপ। তাঁরা বলছেন, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার নিয়মিত জনতা দরবার বসান। সপ্তাহের কবে কোন দফতর নিয়ে তাঁর কাছে সরাসরি অভিযোগ জানানো যাবে, তা নির্দিষ্ট করা আছে। দরবারে যে দফতরের পালা পড়ে, সে দিন তার সচিব তো বটেই, অন্য আধিকারিকেরাও হাজির থাকেন। ফলে মানুষ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সরাসরি অভিযোগ জানালে বিভাগীয় কর্তারাও দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। ওই কর্তাদের বক্তব্য, মমতাও অন্য পথে জনতার দরবারেই আমলাদের দায়বদ্ধ করতে চাইছেন।
প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি এতে রাজনীতিও দেখছেন অফিসারদের অন্য অংশ। তাঁরা বলছেন, সামনেই লোকসভা ভোট। তাই নিয়ে দলগুলি ইতিমধ্যেই নাড়াচড়া শুরু করে দিয়েছে। নির্বাচনের আগে যেমন সব দলই ইস্তাহার বা প্রতিশ্রুতির ফিরিস্তি ঘোষণা করে, তেমনই নতুন বছরের গোড়ায় প্রকল্পের ‘সূচিপত্র’ জনতার দরবারে পৌঁছে দেওয়া সরকারি ইস্তাহারেরই নামান্তর। এই বক্তব্য উড়িয়ে প্রশাসনের একাধিক কর্তার বক্তব্য, সরকার যদি শুধু সাফল্য প্রকাশ করত, তা হলে এ কথা মানা যেত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি মতো কাজ শেষ না হলে সরকারকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে জনতা। এমনকী, ওই প্রকল্প-সূচি ধরে সমালোচনার সুযোগ পাবেন বিরোধীরাও।
নবান্ন সূত্রের খবর, সব কিছু ঠিক থাকলে ২ জানুয়ারি ওই পুস্তিকা প্রকাশ করবে সরকার। তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের জন্য রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনকে নবান্নে আমন্ত্রণ জানিয়েছে রাজ্য। সরকারের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে রাজ্যপাল যদি রাজ্য সচিবালয়ে যান, তা হলে ওই ঘটনা নজিরবিহীন হবে বলে জানাচ্ছেন প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে রাজ্যপালের কোনও সচিবালয়ে যেতেই বাধা নেই। আবার এ-ও ঠিক যে, এমন কোনও প্রথাও নেই। তবে সরকারের একাংশ চাইছেন, রাজ্যের উন্নয়ন-সূচি এক জন অরাজনৈতিক ব্যক্তির হাতেই প্রকাশ পাক।
২ তারিখকে সামনে রেখেই প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার তৈরিতে ব্যস্ত আধিকারিকেরা। নবান্ন সূত্রের খবর, মাসখানেক আগে মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র সব দফতরের সচিবদের চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, এক বছরে তাঁরা কী কী প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছেন, সেই খুঁটিনাটি লিখিত জমা দিতে হবে। সেই নির্দেশে কলকাতা পুরসভা, কৃষি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং সংখ্যালঘু উন্নয়নের মতো কিছু দফতর তাদের কর্মসূচি নবান্নে জমা দিয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার জমা দিতে বলা হয়েছে সবাইকে। না হলে পুস্তিকা তৈরির সময় মিলবে না।”
কী ভাবে তৈরি হচ্ছে ক্যালেন্ডার? ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতর যেমন জানিয়েছে, আগামী এক বছরে তাদের কোন কোন প্রকল্প উদ্বোধন করা যাবে, কোন কোন প্রকল্পের শিলান্যাস হবে। পাশাপাশি কোন মাসে বীরভূম, নদিয়া বা জলপাইগুড়িতে গ্রামীণ হাটের উদ্বোধন করা যেতে পারে, কবে কলকাতায় চালু হবে বিশ্ব বাংলা মার্কেটিং কর্পোরেশন, তারও দিন ক্ষণ রয়েছে প্রশাসনিক ক্যালেন্ডারে। কলকাতা পুরসভা জানিয়েছে, ২৫০টি প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। কোন পর্যায়ে কতটা কাজ শেষ হবে, তার খুঁটিনাটি জানিয়েছে তারা। |