|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২... |
উৎস থেকে নিরন্তর |
সেলিনা হোসেন |
|
আমার প্রথম বইয়ের প্রকাশকাল ১৯৬৯। গ্রন্থে চোদ্দোটি গল্প সংকলিত হয়েছে। সবগুলো গল্পই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে লেখা। বলা যায়, শিক্ষা-জীবনের পাশাপাশি সাহিত্যের হাতেখড়ি। শেখার শুরু। লেখালেখি যে শিখতে হয়, তা প্রথম বুঝেছিলাম যখন অধ্যাপক আবদুল হাফিজ আমাকে অ্যালেন গিন্জবার্গের ‘হাউল’ বইটি দিয়ে বলেছিলেন, এটি পড়ো। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলাম। অসংখ্য ইংরেজি শব্দ বুঝতে পারিনি। ডিকশনারি দেখে নোটবইয়ে সব না-জানা শব্দের অর্থ লিখে পড়েছি। পড়ে ভাললাগার বাইরে একটি লেখাকে বিশ্লেষণ করার বিষয়টিও আমাকে ভাবিয়েছিল।
লেখালেখি শুরু করেছিলাম কবিতা দিয়ে। দুটো ডায়রি ছিল। বড়সড়, মোটা আকারের। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কবিতা লিখে ভরিয়েছি। কেটেকুটে ছিঁড়েছি। যা লিখতে চাইছি, তা পারছি না বলে কেঁদেছি। পরিবারের কেউ দেখবে, এই ভয়ে সব সময় লুকিয়ে রাখতাম ডায়রি। তখনও ইন্টারমিডিয়েট পাশ করিনি। ষাটের দশকের শুরুর দিকের কথা।
ম্যাট্রিক পাশ করি ১৯৬২ সালে, রাজশাহী পি এন গার্লস হাইস্কুল থেকে। স্কুলে পড়ার সময়ই ভাবতাম, কবি হওয়ার চেয়ে বড় কিছু বুঝি আর হয় না। মায়ের কাছ থেকে টিফিনের জন্য পাওয়া পয়সা দিয়ে খাম কিনি কবিতা ডাকে পাঠানোর জন্য। ঢাকার কাগজের ঠিকানা জোগাড় করে বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাই। দু-চারটে ছাপা হয়। বেশির ভাগই হয় না। সে সময় সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার ঈদ সংখ্যা দারুণ হত। দু’তিন পৃষ্ঠা জুড়ে লেখিকাদের পাসপোর্ট সাইজের ছবি ছাপা হত। ভাবতাম, আমার একটা ছবি ছাপা হলে মা’কে দেখিয়ে বলব, আপনার দেওয়া টিফিনের পয়সায় কবিতা পাঠাতে পেরেছি মাগো। দেখুন আমার ছবি ও কবিতা ছাপা হয়েছে। এক দিন সত্যি হল। ডায়রি লুকিয়ে রাখার যে বেড়ি তৈরি করেছিলাম নিজের চার দিকে, মুহূর্তে ভেঙে গেল। ছুটে গেলাম মায়ের কাছে। মা আমার হাতে দুটো টাকা দিয়ে বললেন, ‘টিফিনের পয়সা বাঁচাতে হবে না। এই টাকা দিয়ে দরকার মতো খাম কেনো। লাগলে আবার দেব। পোস্ট করার খরচ আমি দেব।’ সে দিন বুঝেছিলাম, হাতে চাঁদ পাওয়া কাকে বলে। আরও বুঝেছিলাম, আমার সাহিত্যচর্চার পাশে আমার পরিবার আছে।
১৯৬৪ সালে রাজশাহী শহরের কমিশনার বিভাগীয় কলেজের মধ্যে সাহিত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। আমি রাজশাহী মহিলা কলেজের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার এক জন প্রতিযোগী ছিলাম। এক দিন আমাদের ইংরেজি শিক্ষক আবদুল হাফিজ বললেন, ‘কলেজে চিঠি এসেছে প্রতিযোগী পাঠানোর জন্য। আমরা সব বিষয়ে তোমার নাম পাঠাব। বিষয়গুলো হল— বাংলা বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, বাংলা নির্ধারিত বক্তৃতা, ইংরেজি নির্ধারিত বক্তৃতা, বাংলা কবিতা আবৃত্তি, ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি, গল্প লেখা।’ আমি ভয়ে আতঙ্কে চোখ বড় করি। বলি, ‘স্যর, আমি গল্প লিখতে পারব না, উপস্থিত বক্তৃতাও পারব না।’ স্যর ধমক দিয়ে বললেন, ‘না পারলে না-পারবে। কিন্তু প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে। যাও প্রস্তুত হও।’ কী আর করা! নির্ঘুম রাত কাটিয়ে একটি গল্প লিখি। প্রেমের গল্প লিখেছিলাম, মনে আছে। ফল প্রকাশ হলে দেখি, আমার গল্প প্রথম হয়েছে। ১৯৬৪ আমার জীবনে একটি বাঁক বদলের সময়। সাতটি বিষয়ের মধ্যে ছ’টিতে প্রথম হই, একটিতে তৃতীয়। সে বছরই ঠিক করি, আর কবিতা লিখব না, গল্প লিখব। ১৯৬৬ সালে রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে বাংলা সাহিত্যে অনার্স নিয়ে ভর্তি হই। এ সময়ে বেশ অনেকগুলো গল্প লিখি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সে সব পত্রিকায় লেখা ছাপা হয়েছে। ঢাকার কাগজে ছাপা হয়েছে। মোটামুটি পাঠকের কাছে পৌঁছতে পেরেছি। একটু আশ্বাস মনে জমতে থাকে। লেখালেখি ছাড়ব না এমন একটি ধারণা নিতে থাকি।
আমার একটি সোনালি শৈশব ছিল। বাবার চাকরিসূত্রে আমরা থাকতাম বগুড়া জেলার করতোয়া নদীর পাড়ের একটি চমৎকার গ্রামে। সেই সময়ে প্রকৃতি ও মানুষ দেখার সুযোগ হয়েছিল। প্রকৃতি কী ভাবে মানুষের জীবনকে পূর্ণ করে, পরিচর্যা করে, তা যেমন দেখেছি, তেমন দেখেছি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কসূত্র। মানুষের আচরণ কত রকমের হতে পারে— ভাল ও মন্দ দু’ভাবেই, তা দেখার সুযোগ হয়েছে। নানা ঘটনার স্মৃতি আমার ভেতরে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে শৈশবে দেখার সূত্রগুলো আমার কাছে নানা ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হয়। মনে হয়েছিল, এ সবই লেখার উপাদান। কবিতায় সে-সব প্রকাশ সম্ভব নয়। তার জন্য গদ্য দরকার। গল্প কিংবা উপন্যাস। |
|
তবে এটিও স্বীকার করতেই হবে, লেখক হওয়ার তাড়না থেকে আমার প্রথম গ্রন্থটি প্রকাশ করিনি। ১৯৬৮ সালে এম.এ. পাশ করার পর চাকরি খোঁজার চেষ্টা করি। ১৯৬৯ সাল পার হয়ে যায়। আমার শিক্ষক আবদুল হাফিজ বললেন, যে-সব গল্প লিখেছ, তা পাঠকের দৃষ্টিতে পড়েছে। তোমার গল্পের বিষয়গুলো নানামুখী। সংখ্যাও কম নয়। একটি বই হতে পারে। চাকরির দরখাস্তের সঙ্গে যে সিভি দেবে, সেখানে একটি বাড়তি যোগ্যতা যোগ হবে বই থাকলে। বললাম, কী এমন লিখেছি যে বই করতে হবে। না স্যর, আমি বই ছাপব না।
স্যর বললেন, লেখক হতে পারবে কি না, সেটা অনেক পরের ব্যাপার। চাকরি জোগাড় করো। নিজের পায়ে দাঁড়াও।
মনে মনে ভাবলাম, শুধু চাকরি পাওয়ার জন্য আমার গল্পের বই! এত কষ্ট করে, কত কল্পনা করে গল্প লিখেছি, তার ফল শুধুই চাকরি! ভীষণ দমে গেলাম। তার পরও ভয়ে ভয়ে বললাম, স্যর আমার বই কে প্রকাশ করবেন? তরুণ লেখকের বই—
স্যর নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, কোনও প্রকাশকই প্রকাশ করবে না। বাবার কাছে টাকা চাও। নিজেকেই প্রকাশ করতে হবে।
মোটামুটি একটা খরচের হিসেব দাঁড় করালে আব্বা টাকা দিলেন। বইয়ের মুদ্রণের ব্যাপারে স্যর খুব সহযোগিতা করলেন। প্রেস ঠিক করা, প্রুফ দেখা, কাগজ কেনা, ইত্যাদি অনেক কাজের পরে বই বের হল। আনন্দ ধরে রাখার জায়গা পাই না। বইয়ের গন্ধ শুঁকে অভিভূত হই। বই উৎসর্গ করি বাবা-মাকে। মায়ের কাছে গিয়ে বললাম, মাগো কবিতা পাঠানোর জন্য ডাক খরচ দিতেন। বই প্রকাশের খরচও আপনারা দিলেন। লেখাপড়া শিখিয়েছেন। এ বই আপনাদের। বাবা হেসে বললেন, কবিতা লিখে তো লুকিয়ে রাখতে। এখন আর লুকিয়ো না।
চার বছরে চোদ্দোটি গল্প লিখেছিলাম। বিষয় নিয়ে ভেবেছি, প্রকরণ নিয়ে ভেবেছি। নিজের গল্পের ক্ষেত্রটি অন্যের চেয়ে আলাদা করার চেষ্টা করেছি।
সেই সময়ে বইটির সমালোচনা লিখেছিলেন কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আজাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই তিনি বেশ কট্টর সমালোচক ছিলেন। ১৯৭০ সালে আমি বাংলা একাডেমিতে জয়েন করার পর আমার সঙ্গে পরিচয়। তাঁকে এক কপি বই দিয়েছিলাম। কঠোর সমালোচনার ভয়ে রিভিউ করার কথা বলিনি। হুমায়ুন নিজের ইচ্ছায় সমালোচনা লিখেছিলেন। বিস্মিত হয়ে দেখেছিলাম, বইটির প্রশংসা করলেন তিনি। আজ তিনি নেই। মৌলবাদীদের হাতে নিহত হয়েছেন। তাঁকে স্মরণ করি।
১৯৭০ সালের দিকে ঢাকা টেলিভিশনে বই নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করতেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। (মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৪ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। তাঁর মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।) অধ্যাপক আবদুল হাফিজের তিনি বন্ধু ছিলেন। হাফিজ স্যর তাঁকে এক কপি বই দিয়ে বলেছিলেন, আপনার অনুষ্ঠানে এই বইটি আলোচনা করে দেবেন। শহিদ মুনীর চৌধুরি টেলিভিশনে সেই অনুষ্ঠানে গল্পের প্রশংসা করেছিলেন।
১৯৭০ সালেই দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে কাছাকাছি সময়ের ব্যবধানে ইন্টারভিউ কার্ড পাই। একটি বাংলা অ্যাকাডেমি, অপরটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন। অর্থাৎ সরকারি কলেজে। আমার দুটো চাকরিই হয়। আমি কলেজের চাকরিতে না গিয়ে বাংলা অ্যাকাডেমিতে যোগদান করি। এখন ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ প্রকাশের ৪৪ বছর পার হয়েছে। যে স্মৃতি আমাকে অহরহ পীড়া দেয়: আমি লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হব এক দিন, এমন চিন্তা থেকে বইটি প্রকাশ করিনি। একটি চাকরি পাওয়ার বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। এখন মনে হয় সেটিও বোধহয় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল না। একই বছরের কাছাকাছি সময়ে আমার দুটো চাকরি হয়েছিল। একটি বই আমার আর্থিক সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রের নিয়ামক ছিল।
তার পরও আমার লেখকজীবন থেমে থাকেনি। আমার পথ চলায় প্রথম বইটি আমার সঙ্গী। বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশ করে ভূমিকা প্রকাশনা, ২০০৯ সালে। মাঝখানে ‘নির্বাচিত গল্প’ শিরোনামে প্রকাশিত বইয়ে এই গ্রন্থের বেশ কয়েকটি গল্প মুদ্রিত হয়েছে। পরে ‘গল্পসমগ্র’ গ্রন্থে বইটির সব গল্প মুদ্রিত হয়েছে। |
|
|
|
|
|