|
|
|
|
|
|
ল্যাজে পা |
চিরশ্রী মজুমদার |
ঘন সবুজ টাটকা সজীব ফুটবল গ্রাউন্ড। নিখুঁত সাদা দাগ আঁকা। দেখলেই ছুটে গিয়ে জাস্ট শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। কিন্তু মাঠে কোথায়! আপনি তো গ্যালারিতে বসে। চার পাশে চিপ্স, সসেজ, কোল্ডড্রিংক-এর খিদে লাগা গন্ধ। হঠাৎ ফিসফাস, ছেঁড়া ছেঁড়া ড্রাম-মিউজিক উল্লাস-হুহুঙ্কার হয়ে গর্জে উঠল। উই উইল উই উইল রক্ য়্যু। টিম মাঠে। রেফারি হুইস্ল মেরে বলটাকে ঠেলে দিল ওদের জটলায়। খেলা শুরু। সেকেন্ডে কামাল দেখাতে শুরু করল দশ নম্বর। ড্রিব্ল, পাস, ডজিং-এর কোহিনুরগুলো ওর খেলায় ঝিলিক দিচ্ছে। দুষ্টু মার্কারগুলো হাঁপাতে হাঁপাতে পিছিয়ে পড়ে মাথা নাড়ছে। চিতা ছুটছে জালের দিকে।
তা, দেখলেনটা কাকে? এক কোটি ডলারের বাজি, লিয়োনেল মেসিকে দেখেছেন, যেহেতু দশ নম্বর জার্সি বলেছি। একশোয় এক জনও চিডি, ওডাফা বা টোলগে’কে ছুটতে দেখেননি। যদি বলতাম সাত, নির্ঘাত ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো বা দাভিদ ভিয়াকে দেখতেন। হলদে-সবুজে কাকাকে দেখতেন। কারণ, অতি বড় কট্টর সমর্থকও মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের সাত নম্বর কে, ভাবতে সামান্য হোঁচট খায়। বিদেশিদেরই দেখছিলেন কারণ, এত ক্ষণ তো বসেছিলেন কোনও বিশ্বকাপ-ইউরো কাপ-কোপা আমেরিকা চলা ঝকঝকে স্টেডিয়ামে। খেলার এইটুকুন, ইতনা সা ভি সমঝদার হলেও কিছুতে যুবভারতীতে বসেননি। আপনার স্বপ্নের খেলায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-বায়ার্ন মিউনিখ-রিয়াল মাদ্রিদ-সাম্বা-এল ক্লাসিকো ছিল। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান এই ড্রিমল্যান্ডের মাইলখানেক দূরেই সিকিয়োরিটির তাড়া খেয়ে পিঠটান দিয়েছিল। ঢোকার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি।
তবে, মনের ম্যাচেও এমনধারা গোহারান হারার ও অবনমন খাওয়ার কারণ হচ্ছে, তোমাদের ভাই, না সুরত হ্যায় না সিরত। যাহ্! এ কোনদেশি ভাষা বললাম? তা হলেই দেখো, তোমরা আমাদের কথাই বোঝো না, আগামিকাল তো দূর আমাদের বর্তমানের সঙ্গেই ম্যাচ করো না, এক সঙ্গে চলব কী ভাবে? সিরত বলতে, গুণপনায় লবডঙ্কা। এ খেলার নিয়মকানুন ভাল জানি না বুঝি না, সেই আমার চোখেও কড়কড় করে ঠিকরে লাগে তফাতখানা। ওদের তুলনায় কী স্লো, কত খারাপ খেলো তোমরা। সে সব দিন সোনার ছিল কারণ তোমরা ছাড়া চোখের সামনে অন্য কেউ ছিল না, আর আজ? অপশন বেড়ে গিয়েছে, কম্পিটিশন এসে গিয়েছে। অযুত নিযুত কোটি কোটি গুণ ভাল জিনিস পাচ্ছি ঘরে শুয়ে-বসে, এমনি এমনি কেব্ল টিভিতে অত দামী প্যাকেজে সব ক’টা স্পোর্টস চ্যানেলগুলো নিলাম নাকি? বাড়ি বয়ে এসে বাদশাহি খানা দিয়ে যাচ্ছে, খামখা ধাপধাড়া গোবিন্দপুর গিয়ে ধুলোপড়া টেস্টলেস ঘুগনি খেতে যাব কোন আক্কেলে? |
|
ঐতিহ্য। ঘরের লোক। বাপ-দাদার জিনিস। পয়েন্ট বটে। কিন্তু তার মানেই তো চাকলা-ওঠা আলমারিতে তুলে রাখার জিনিস, রোজ ব্যবহার করলে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে খতম। এই তো শ্রদ্ধা-সম্মান দিচ্ছি, ইতিহাসে থাকো আরাম করে, একটা অনুচ্ছেদ ডেডিকেট করতে কী যায় আসে? আইএফএ শিল্ড, গোষ্ঠ পাল, আসিয়ান ক্লাব কাপ জয়ের কথাগুলো ভাল জিকে-র বইতে থাকবেই। ঘণ্টা আড়াই ফ্রি পেলে ‘ধন্যি মেয়ে’টা দেখা যেতে পারে। ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’ গানটা জেনে রাখাও বেজায় ভাল। ওতে আবেগ-টাবেগ কিছু আর আসে না অবশ্য, তবে ওই প্রথম লাইনটা জানা থাকলে অন্ত্যাক্ষরী খেলতে খুব সুবিধে হয়। ‘স’ অক্ষরটা ঘুরেফিরে বড্ড আসে কিনা। আর ক্লাবগুলোকে ছবি-টবি দিয়ে এ বার মিউজিয়াম বানিয়ে দিতে পারো, কলকাতায় ঘোরার জায়গা কমই, নস্টালজিয়া সব সময়েই প্রোডাক্ট হিসাবে হিট করে। হেরিটেজ সাইটের সামনে গরুর গাড়ি সাজানো থাকলে, পোজ দিয়ে ভীষণ ভাল ছবি তোলা যায়, তবে আজকের দিনে ওটা চেপে পার্ক স্ট্রিটে ঘুরতে গেলে জেলে পুরে দেবে।
ঘ্যানঘ্যানানিটা থামাও। জন্ম ইস্তক ফিফা র্যাংকিংয়ে ইন্ডিয়াকে ১২০ টু ১৪০-এ ঘুরতে দেখে চূড়ান্ত বোর। গত কয়েক বছর ভয়েই কেউ আর ফিফা র্যাংকিং দিলে খোঁজও নেয় না। ফাঁকা খাতা জমা দিয়ে কেউ নিজে রেজাল্ট জানতে যায়? এখন তো শুনলেও গা জ্বালা লাগে, এখানে না পুষ্টি নেই। ছেলেপিলেদের তাকত হয় না তো দম রাখবে কী করে, ভিনদেশিদের পাহাড়ের মতো ফিজিকের সঙ্গে পাল্লা দেবে কী করে। ট্রেনিং নেই। পরিকাঠামো নেই। ধুর ধুর। এ বার আমরা বলি? চান্স খোঁজার ইচ্ছে নেই, নিষ্ঠা নেই, প্রতিভা নেই। থাকলেও তাকে সচিন, নিদেনপক্ষে একটা জাপান ফুটবল টিম বানানোর পরিশ্রম নেই। দু-একটা ঠিকঠাক জিম বানিয়ে ‘এই তো অনেক আধুনিক হওয়া গেছে’ বলে বসে পড়লে, আর শুধু মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল কে কত বার মুখোমুখি হয়ে কী কী করল তাই নিয়ে পড়ে থাকলে, অমনিই হবে। চারটে অন্য টিমকে তুলোধোনা করে, দেশ-বিদেশে নাম কুড়িয়ে ঘরে ফিরে দুজনে পাঞ্জাটা লড়তে, তার পর দেখতে।
সুরতের কথায় আসি। সুরত মানে, প্রেজেন্টেবিলিটি। আজকের দিনে পাবলিক প্ল্যাটফর্মে আসতে গেলে, বডি ল্যাংগোয়েজ, স্টাইলিং, অ্যাটিটিউড, সবটা মিলিয়ে নিজেকে একটা প্যাকেজ বানিয়ে তুলতে হয়। সেটা কিছুটা নিজে হয়, কিছুটার জন্য ট্রেনিং লাগে। সে সবে বিলকুল পাত্তা না দিলে, ইন্টারভিউও ঠিক করে দেওয়া যায় না, তোতলাতে হয়, আবার মাঠে দাঁড়িয়েই কোচের সঙ্গে বিতকিচ্ছিরি ব্যবহার করে নেগেটিভ ইমেজে তা দেওয়া হয়। রায়না-কোহলি-কুইন্টন ডি কক’রা কিচ্ছু ড্রিমবয় নয়, কিন্তু ওরা মাঠের ভেতরে ও বাইরে, নিজেদের দুরন্ত প্রেজেন্টেব্ল রাখতে জানে। তাই ওরাই ভবিষ্যতের আইকন। কারণ, খেলাধুলোটা তো এখন অব কোর্স পার্ট অব বিনোদন।
গ্ল্যামার ছাড়া কিচ্ছু বুঝি না আমরা। তাই তো? এ বার একটা গভীর, ভীষণ সত্যি কথার তাসটা দেখাই? যেটা আসলে জীবনে জিতে যাওয়ার, হইহই করে টিকে থাকার প্রেসক্রিপশন? বন্ধু, লাইফের কোনও ফিল্ডেই ভালবাসা জিনিসটা এমনি এমনি পাওয়া যায় না। ও আমার থেকে কেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বলে পাঁচকথা না শুনিয়ে, আমাকে কেন আর পাত্তা দেয় না বলে মান-অভিমান-ডিপ্রেশন না ঘনিয়ে, সোজাসাপটা তার চিত্তহরণ করতে জানতে হয়। যে পারে না, তার লাইফ ফিনিশ। তার জীবনেই এ সব হেরে যাওয়া, দুঃখ-কষ্ট অন্ধকার দিন, অবহেলা আসে। ভালবাসা পেতে গেলে কিন্তু, ভালবাসার যোগ্য হয়ে উঠতে হয়। উঠে দাঁড়াতে হয়।
ঠিক ওইটাই তোমরা পারলে না। তাই, তোমাদের গেম ওভার। এরোপ্লেন-ইন্টারনেট-ওয়েবক্যাম-উই চ্যাটের ছোট্ট পৃথিবীতে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়ে মাতামাতির দিন অস্ত গিয়েছে। আমাদের, মানে রুলিং প্রজন্মের শয়নে স্বপনে এখন ইউরোপের ক্লাবগুলো আর ব্রাজিল আর্জেন্টিনা দেশগুলো। আমাদের কাছে জন্মশত্রুর লড়াই রোমাঞ্চ মানে বার্সা ভার্সেস রিয়াল। ইংল্যান্ড-জার্মানি। ওদের নিয়েই আমরা হল্লা করব, ম্যাগাজিনে ওদের চব্বিশ ঘণ্টা-ওদের বায়োগ্রাফি-বান্ধবীদের কথাই পড়ব। ওদের খেলা দেখব, পারলে ওদের দেশের স্টেডিয়ামে গিয়ে, না পারলে এ দেশে বসে টিভিতে। রাত জেগে। সে সময় না-ই মিলুক ঘড়ির সঙ্গে, আমাদের ইচ্ছে, আমাদের চাওয়া, আমাদের তুফানি প্রাণের সঙ্গে ওরাই মেলে। আমরা বাঙালি নই তো, আমরা হলাম গ্লোবাল সিটিজেন। তোমরা আমাদেরই মন জিততে পারোনি। ইলিশ-চিংড়িতে ভীষণ আঁশটে গন্ধ লাগে আমাদের। তার থেকে মিক্সড চাউমিন অনেক ভাল। |
|
|
|
|
|