নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আধুনিকরা কেউই তাঁকে পছন্দ করেন না। ব্রাহ্মণ্যবাদী, নারীবিদ্বেষী শভিনিজ্মের পূর্বপুরুষ। মনুসংহিতার একাদশ অধ্যায়ের ১৭৪ নম্বর শ্লোকে কুখ্যাত সেই মনুর বিধান: পশুতে, রজস্বলা যোনি ভিন্ন অন্য স্থানে এবং জলে রেতঃসেক করলে সান্তপন ব্রত পালন করতে হবে।
প্রসঙ্গত, সান্তপন ব্রত খুব সহজ। এক দিন গোমূত্র, গোময়, দুধ, দই, ঘি একত্র খেতে হবে। পরের দিন উপবাস। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য স্বেচ্ছায় মদ খেলে তার শাস্তি অবশ্য সাংঘাতিক। যত ক্ষণ না মৃত্যু হয়, অগ্নিতে তপ্ত গোমূত্র পান করতে হবে। সোজা কথায়, মদ্যপানের শাস্তি মৃত্যু। আর বিকল্প যৌনতা (Queer)? ছোট্ট শাস্তি দিয়ে ঠারেঠোরে মেনে নেওয়া হল।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ধরা যাক। প্রাচীন সব আইন। বউ বেগড়বাঁই করলে তিন থাপ্পড় লাগাতে হবে ইত্যাদি কথায় ভরতি। সে বইয়ের অষ্টম অধ্যায়ে বিধান: কোনও নারী-পুরুষ যদি অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে বা সমলিঙ্গে রতিক্রীড়া করে, সামান্য জরিমানা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। মনুষ্যেতর প্রাণীর সঙ্গে করলে ১২ পণ জরিমানা। দেবদেবীর সঙ্গে হলে ২৪ পণ। সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে রতিলিপ্ত হলেও ২৪ পণ। আর অন্যের খেত থেকে ধান চুরি করলে জীবন ছারেখারে যাবে। ২০০ পণ জরিমানা। জরিমানার অঙ্কই জানিয়ে দেয়, চুরি-ডাকাতি নিয়ে শাসকদের যে মাথাব্যথা ছিল, যৌনতার রকমফের নিয়ে তার সিকি ভাগও নয়।
মনু এবং কৌটিল্য দুজনেই আইনের কথা বলেন। আইন কিন্তু সামাজিক প্রথাকেই স্বীকৃতি দিয়েছিল। বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্রম্’-এ নবম অধ্যায়টি ‘ঔপরিষ্টকম্’ নিয়ে। যাঁরা নারী নন, পুরুষও নন, সেই তৃতীয় লিঙ্গের যৌন আচরণই ঔপরিষ্টকম্। বাৎস্যায়নের আক্ষেপ, যেখানে ঔপরিষ্টক বা মুখমেহন প্রয়োজন নেই, সে সব জায়গাতেও আজকাল এ সব ঘটছে!
|
এই সব মনুসংহিতা, অর্থশাস্ত্র বা কামসূত্র প্রাচীন বিধান। তখন আমরা অসভ্য ছিলাম। সংসদীয় গণতন্ত্র এবং আদালতের আইনসম্মত আধুনিকতা ছিল না। কিন্তু ঐতিহ্য অস্বীকার করব কী ভাবে? সমকামিতা অবশ্য আমাদের ব্যাপার নয়। গ্রিকরাই এ সব উল্টোপাল্টা ব্যাপারের জন্য দায়ী। তারা জিমনাসিয়ামে কুস্তি লড়ত, দর্শনচর্চা করত, তার পর বাচ্চা ছেলেদের নিয়ে বিছানায় যেত। প্লাতো, আরিস্ততত্ল, সোক্রাতেস— কেউ ব্যতিক্রম নন। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি জি এস সিঙ্ঘভি ও এস জে মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ সাধে বলেছেন, ‘বিদেশি আইন অন্ধ ভাবে এ দেশে প্রয়োগ করা চলে না।’ কৃত্তিবাস ওঝা অবশ্য বিদেশি নন। বাংলা রামায়ণের স্রষ্টা, মধ্যযুগে ফুলিয়া গ্রামের সেই কৃত্তিবাস! কুয়ের নিয়ে সেই সময়ের বাংলায় তিনি যে আধুনিকতা দেখিয়েছিলেন, আমরা তার ধারেকাছে আসি না।
সগর রাজার পৌত্র ভগীরথ যে তপস্যার বলে গঙ্গাকে মর্ত্যধামে নিয়ে এসেছিলেন, সবাই জানে! বাল্মীকি রামায়ণ এবং ব্যাসদেবের মহাভারত দুই মহাকাব্যেই ঘটনাটি আছে। রাজা দিলীপ পুত্র ভগীরথের ওপর রাজ্যভার দিয়ে স্বর্গে গেলেন। ভগীরথ জানেন, গঙ্গাকে মর্তে আনলে পূর্বপুরুষরা মুক্তি পাবেন।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ এই উপাখ্যানটিতেই ছোট্ট অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে দিল। দুই রানিকে রেখে, সন্তানহীন রাজা দিলীপ মারা গিয়েছেন। দেবতারা প্রমাদ গুনলেন, সর্বনাশ! ভগীরথ জন্মাবে কী ভাবে? পৃথিবীতে গঙ্গাকেই বা নিয়ে যাবে কে?
অগত্যা শিব দুই বিধবা রানির কাছে হাজির। কৃত্তিবাসের ভাষায়, ‘শঙ্কর বলেন, দুই জনে কর রতি/ মম বরে একের হইবে সুসন্ততি।’ এবং ফুলিয়ার বামুন শুধু ওইটুকুতেই ছেড়ে দিলেন না। ম্যাজিক ঘটালেন, ‘দোঁহে কেলি করিতে একের হৈল গর্ভ।’ কিন্তু যে বাচ্চাটি হল, তার হাড়গোড় নেই। দুই রানি সেই মাংসপিণ্ডটি নদীর ধারে রেখে এলেন। অষ্টাবক্র ঋষি তখন স্নানে যাচ্ছেন। অস্থিহীন, বিকৃত শিশুকে দেখে ঋষি ভাবলেন, ‘আমাকে ভ্যাংচাচ্ছে? ব্রহ্মশাপে এখনই মরবে। আর বেচারির দেহটা যদি ওই রকম হয়, এখনই আমার বরে কন্দর্পকান্তি হয়ে উঠুক।’ বাচ্চাটা সুস্থ শরীরে, সুন্দর চেহারায় হাঁটি-হাঁটি-পা উঠে দাঁড়াল। কৃত্তিবাসী কথকতায়, ‘ভগে ভগে জন্ম হেতু ভগীরথ নাম।’ সমকামিতাকে ‘অপরাধ’ বললে মা গঙ্গাও তাই লজ্জা পাবেন!
গঙ্গা উত্তর ভারতের নদী, কৃত্তিবাস গৌড়বঙ্গের কবি। কিন্তু দক্ষিণ ভারতও অক্লেশে মেনে নিয়েছে আয়াপ্পাকে। কেরলের সবরিমালা পাহাড়ে আয়াপ্পার মন্দিরে যাওয়া হিন্দু ঐতিহ্য। এই আয়াপ্পা শিব ও বিষ্ণুর সন্তান। বিষ্ণু নারীবেশে ‘মোহিনী’ মূর্তি ধারণ করলেন, শিব সেই নারীতে মুগ্ধ হয়ে রতিক্রীড়ায় মাতলেন। যথাকালে বিষ্ণুর পুত্র হল। এ বার লজ্জা পেয়ে তিনি ছেলেকে পৃথিবীতে ফেলে বৈকুণ্ঠে ফিরে গেলেন। রাজশেখর নামে এক রাজা সেই ছেলেকে পালন করলেন, তারই নাম আয়াপ্পা। তিনি বড় হয়ে অনেক দৈত্য নিধন করলেন। বাবর নামে এক মুসলমান হয়ে উঠল তাঁর প্রধান বন্ধু। লীলা নামে এক অভিশাপগ্রস্ত সুন্দরী মোষের রূপ ধারণ করেছিল, আয়াপ্পা তাঁকে উদ্ধার করলেন। লীলা এ বার আয়াপ্পাকে বিয়ে করতে চাইলেন, দেবতা জানালেন, বিয়ে-টিয়ে করতে পারব না। বাবর আমার প্রাণসখা। তুমি আমাদের সঙ্গে থাকতে পারো। আজও আয়াপ্পামূর্তির ডান দিকে থাকেন বাবর, বাঁ দিকে লীলা। কিন্তু সবরিমালার মন্দিরে আজও যে স্থানীয় মুসলমানরা রয়েছেন, তাঁরা নিজেদের বাবরের উত্তরপুরুষ বলেন। উৎসবের রাতে মন্দিরচত্বরে পুরুষদের নাচগান হয়। এক জন আয়াপ্পা সাজেন, অন্য জন বাবর। আয়াপ্পা তাঁর বাবাকে বলেছিলেন, ‘সবরিমালার মন্দিরটা বাবরের নামে উৎসর্গ কোরো। ওর সঙ্গে আমার কোনও তফাত নেই।’ শিব-বিষ্ণু, স্থানীয় উপকথা, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি একটার পর একটা প্রলেপ জড়িয়ে মিশে গিয়েছে এই গল্পে। কিন্তু যে দেশে আয়াপ্পা, বাবর আছেন, হরগৌরী এবং অর্ধনারীশ্বর মূর্তির পাশাপাশি এক শরীরে শিব এবং বিষ্ণুর হরিহরমূর্তিও পূজিত হয়, সেখানে কুয়ের (Queer) সম্পর্ক বারংবার এত ধাক্কা খায় কী ভাবে?
জৈন ধর্মও এই সাহসিকতার উত্তরাধিকার। নবম শতাব্দীর জৈন দার্শনিক ও ব্যাকরণবিদ শাকাত্যায়ন তাঁর ‘স্ত্রীনির্বাণপরিক্রমা’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তিন রকমের কামনা (বেদ) আছে। পুরুষ, নারী ও তৃতীয় কামনা। তৃতীয়টিই সবচেয়ে শক্তিশালী। কোনও মানুষ তাই বিপরীত লিঙ্গ ছাড়া সমলিঙ্গ এমনকী মনুষ্যেতর প্রাণীদের প্রতিও আকৃষ্ট হতে পারে। জৈন মতে কামনা আকার-অবয়বহীন, নির্বিকল্প ও ক্ষণস্থায়ী।
উদাহরণ রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মেও। মণিকণ্ঠ জাতকের গল্প মনে পড়তে পারে। দুই ভাই ব্রহ্মচারী হয়ে তপস্যা করে। নাগরাজ ছোট ভাইকে দেখে মুগ্ধ। রোজ আসেন, ছোট ভাইকে জড়িয়ে শুয়ে থাকেন। ছোট ভাই ভয়ে কিছু বলতে পারে না। এক দিন সে দাদার কাছে হাজির। দাদা জিজ্ঞাসা করলেন, তোকে এত রোগা, শুকনো দেখাচ্ছে কেন? ভাই উত্তর দিল, রোজ একটা সাপ আসে। ভয়ে কিছু বলতে পারি না। দাদা উত্তর দিলেন, পরের দিন এলে ওর মাথার মণি চাইবি। ভাই তাই চাইল, নাগরাজ ভয়ে হাওয়া।
কয়েক দিন পরে দাদা গেলেন ভাইয়ের কাছে। ভাইয়ের আরও রোগা, ক্ষয়াটে চেহারা। দাদার প্রশ্নের উত্তরে ভাই জানাল, ‘নাগরাজ আসে না, তাই ভাল লাগে না।’
দাদা বলেন, ‘মণি চাইতে গিয়ে তোর মনে লোভ এসেছে। তাই রোগা হয়ে যাচ্ছিস।’ এর পর তথাগত জানালেন, সেই জন্মে আমি ছিলাম বড়দা। আনন্দ ছোট ভাই। হাল আমলে জন গ্যারেট জোন্স জাতকের গল্প বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, বেশির ভাগ জন্মে বোধিসত্ত্বের স্ত্রী থাকে না। কিন্তু স্ত্রীর থেকেও বিশ্বস্ত বন্ধু থাকে। আশি শতাংশ জাতকের গল্পে আনন্দই সেই বিশ্বস্ত বন্ধু কাম ভাই।
হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈনদেরও আগে যাঁরা ছিলেন? ঋগ্বেদের সেই আর্যদের কথাই ধরা যাক! সেখানে ইন্দ্র, অগ্নিই প্রধান দেবতা। অগ্নির বাবা নেই, দুই মা: পৃথিবী এবং স্বর্গ। যজ্ঞস্থলে অগ্নি কী ভাবে উৎপন্ন হয়? দুটো কাঠ ঘষতে হয়। কাঠগুলিকে বলে, অরণি। উল্লেখ্য, অরণি শব্দটি সংস্কৃত ভাষায় স্ত্রীলিঙ্গ। ঋগ্বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিরা জানাচ্ছেন, দুটি কাঠ পরস্পরের মধ্যে প্রবিষ্ট হলে অগ্নির জন্ম হবে না। স্ত্রীলিঙ্গবাচক দুটি অরণিকে মন্থন করতে হবে বা সজোরে ঘষতে হবে। ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডলে ২৯ নম্বর সূক্তের তৃতীয় শ্লোক: ‘হে জ্ঞানবান অধ্বর্যূ! তুমি উর্দ্ধমুখ অরণিতে অধোমুখ ধারণ কর। তৎক্ষণাৎ গর্ভবতী অরণি অভীষ্টবর্ষী অগ্নিকে উৎপন্ন করিল।’
এ সবই প্রাচীনকালের কথা। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন নির্বিশেষে এ দেশের সব ধর্মই তখন বিকল্প যৌনতাকে স্বীকার করে নিত। একুশ শতকে অবশ্য অন্য কাহিনি!
|