এই গলিতে কারও সঙ্গে মেশেন না মেজর সরখেল। প্রথম কারণ হল, তিনি আর্মির অবসরপ্রাপ্ত মেজর। তাঁর মতে হায়েস্ট ফর্ম অব সার্ভিস অব দ্য নেশান। সেখানে এই গলির অন্যান্যরা হলেন ছোট ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মচারী বা স্কুলশিক্ষক। আর দ্বিতীয় কারণ হল, তাঁর আদরের ল্যাবরাডর কুকুর সোনি। সোনির জন্যে তিনি কারও সঙ্গে মেশেন না।
দ্বিতীয় কারণটা শুনে সরখেলের স্ত্রী যশোদা হাঁ হয়ে গিয়ে বলেছিলেন, সে কী গো! সোনির জন্যে তুমি কারও সঙ্গে মেশো না!
সরখেল খুব গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, দেখো মনিবকে দেখে তার পোষ্য স্বভাব তৈরি করে, আমি যদি যার-তার সঙ্গে মিশি তবে আমার দেখাদেখি ও গলির কুকুরগুলোর সঙ্গে মিশতে থাকবে, আমার পেডিগ্রি হাই, আমি ছিলাম আর্মিতে, আর সোনির পেডিগ্রি কী জানো?
যশোদা থতোমতো খেয়ে বলেছিলেন, কী?
ওর বাবা ছিল রাজ্যপালের বাড়িতে, ওর মা ছিল মুম্বইতে এক রকস্টারের বাড়িতে, তুমি দেখবে ওকে আমি কোথায় নিয়ে যাই, সামনের সপ্তাহ থেকে ট্রেনার আসছে, ট্রেনিং দিয়ে ওকে আমি এমন জায়গায় নিয়ে যাব, ও এক দিন সেলিব্রেটি ডগি হয়ে উঠবে...
যশোদা আর কথা বাড়াননি। বুঝেছিলেন কর্তার মাথাটা গিয়েছে।
ট্রেনার আসতে থাকল। হার্ড ট্রেনিং। ট্রেনার চলে গেলে ওঁর দেওয়া ট্রেনিং সোনিকে সরখেল দিতে থাকেন। খাওয়া ঘুমোন আর বাথরুমে যাওয়া ছাড়া সরখেল সোনিকে নিয়েই পড়ে থাকেন। কিন্তু এত কিছু করেও সোনির শিক্ষার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। এক দিন ট্রেনারকে সে কথা বললেনও। ট্রেনার ভদ্রলোক বললেন, আসল কথাটা কী জানেন, ও তো অন্য কোনও কুকুরের সঙ্গে মেশে না, ওর মন ভাল নেই, তাই ট্রেনিং ঠিকঠাক নিতে পারছে না...
সরখেল খেপে গেলেন, কী বলছেন, রাস্তার কুকুরগুলোর সঙ্গে ও মিশবে!
রাস্তার কুকুরের সঙ্গে মিশবে কেন? আপনার পাশের পাড়ায় সুধীরবাবু থাকেন, ওঁরও একটা ল্যাবরাডর আছে, আমিই ট্রেনিং দিই, ওঁকে বলে দিচ্ছি উনি ওঁর কুকুর নিয়ে মাঝেমধ্যে আপনার এখানে চলে আসবে আর আপনিও আপনারটাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে ওখানে চলে যাবেন।
সরখেল সব শুনে বললেন, সুধীরবাবু কী করেন? |
রিটায়ার্ড আই এ এস।
প্রোমোটি না ডাইরেক্ট?
ট্রেনার ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বললেন, তা তো ঠিক জানি না।
ঠিক আছে চলে যাবে।
হ্যাঁ?
ও আপনি বুঝবেন না।
ট্রেনার ভদ্রলোকও আর বুঝতে গিয়ে নিজের বোঝা বাড়ালেন না।
সুধীরবাবু ওঁর ল্যাবরাডরটাকে নিয়ে মেজর সরখেলের বাড়িতে আসতে থাকলেন। প্রথম প্রথম ট্রেনারের দেওয়া প্র্যাক্টিসগুলো নিয়েই দু’জন দু’জনের কুকুরের পিছনে পড়ে থাকতেন। আস্তে আস্তে যশোদা লক্ষ করলেন সুধীরবাবু আর তার কর্তা আড্ডায় মশগুল। কখনও দাবা খেলছে। কখনও টিভির সামনে ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে উত্তেজিত। আর ঘনঘন কিচেনের দিকে হাঁক আসছে চায়ের জন্যে। আর সেই সুযোগে ট্রেনিং ভুলে কুকুর দুটো নিজেদের মধ্যে খেলছে। কখনও খুনসুটি করছে। সোফার ব্যাকপিলোগুলো ফুটবল বানিয়ে ছেড়েছে। যশোদা বিরক্ত হতেন। আবার খুশিও হতেন।
কর্তার এই বুড়ো বয়সেও চেহারায় আবার জেল্লা এসেছে। আর তাদের সোনিও নধরকান্তি হয়ে উঠেছে।
ভালই চলছিল। কিন্তু সুধীরবাবুর মেয়ের দিল্লিতে পোস্টিং হল। সেখানে বিশাল কোয়ার্টার পেয়েছে। বাবাকে কলকাতায় একা রেখে যাবে না। তাই ল্যাবরাডর সমেত সুধীরবাবু মেয়ের সঙ্গে দিল্লিতে চলে গেলেন। আর কয়েক দিনের মধ্যে যশোদা লক্ষ করলেন কর্তার চেহারার জেল্লা কমে গিয়েছে। সোনি ট্রেনারের কাছ থেকে যা যা শিখেছিল মানে মুখে করে খবরের কাগজ নিয়ে আসা, কেউ ডোর বেল বাজালে ভৌ ভৌ করে তাদের ডেকে দেওয়া, বাগানে অবাঞ্ছিত লোক ঢুকে পড়লে তাকে ধমকানো এ সব ভুলে গেল।
কিন্তু সোনির চেহারার নধরকান্তি ভাবটা গেল না। কথাটা যশোদা মেজর সরখেলকে বলেও ফেললেন। সরখেল কপালে ভাঁজ তুলে বললেন, তাই তো...। বলেই সোনিকে ভাল করে পরখ করার জন্যে ছুটলেন বারান্দায়। পিছনে পিছনে যশোদাও এগিয়ে গেলেন।
বারান্দায় এসে সরখেলের চক্ষু তো চড়কগাছ। ট্রেনিং শিকেয় তুলে তার সোহাগের সোনি পাড়ার একটা নেড়ির সঙ্গে বাগানের জমিতে লুটোপুটি খেয়ে খেলছে।
যশোদা বললেন, সুধীরবাবু চলে গিয়েছেন তুমি ঝিমিয়ে পড়েছ, আর দেখো সোনি কী রকম সঙ্গী খুঁজে নিয়েছে, ওকে কী ট্রেনিং দেবে তুমি, ওর কাছ থেকে তুমি ট্রেনিং নাও...। |