ভয়, রাষ্ট্র এ বার নতুন উদ্যমে অবাধ্যদের শাসন করতে নামবে না তো?
ভরসা, এ বার নতুন উদ্যমে অধিকারের জন্য লড়াই চলবে, চলতে থাকবে।
উষসী চক্রবর্তী |
অনেক কথাই লেখা যেতে পারত। যেমন ধরুন, আইপিসি ৩৭৭ আসলে ব্রিটিশদের বানানো একটি আইন, এর সঙ্গে অনেকে যা বলে থাকেন, সেই ‘ভারতীয় সংস্কৃতি-টিতি’ এ-সবের কোনও সম্পর্ক নেই। বলা যেতে পারত যে, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষ অন্য কারও ক্ষতি না করে, নিজেদের মধ্যে কী সম্পর্ক তৈরি করছে তা নিয়ে পাড়ার জ্যাঠামশায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্র, স্কুলের হেডমাস্টার থেকে শুরু করে আইন বানানোর কারিগর, কারওই কিছু বলার অধিকার থাকে না।
অথবা এ-ও বলা যেতে পারত যে, সমকামী সম্পর্ক যদি অস্বাভাবিক বা প্রকৃতির নিয়মের বিরোধী (‘আগেনস্ট দি অর্ডার অব নেচার’) হয়, তা হলে জন্মনিরোধক ব্যবহার করাও প্রকৃতিবিরুদ্ধ, অতএব অপরাধ। যে কোনও রকম প্লাস্টিক সার্জারিও অপরাধ। বোঁচা নাক সরু করা কি প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে যাওয়া নয়? আর যে সমস্ত মহিলা আস্ত ডিম্বাশয় নিয়ে জন্মে সন্তানের জন্ম দিতে ইচ্ছুক নয়? তাঁরা তো সবচেয়ে বড় প্রকৃতিবিরোধী, অতএব ক্রিমিনাল!
ও হ্যাঁ, বাদ পড়ে গেল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য আর সমাজবিজ্ঞানের দু’একটি বিভাগে কিছু দিন যাবৎ চালু করা হয়েছে: ‘কুয়্যর স্টাডিজ’। স্বীকৃত বিসমকামী সম্পর্কের আওতায় পড়ে না এমন কিছু জীবনযাপন, তার তত্ত্বায়ন, এই সব নিয়ে চর্চা হয়, পড়ানো হয় সেখানে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসে লেসবিয়ান গে সম্পর্ক। এই সব আকথা কুকথা পড়ানোর ও পড়ার দোষে যারা ‘অপরাধী’, তাদেরকেও আটক করার দাবি উঠবে না তো এ বার? সমকামীরা যখন অপরাধী, তখন এই বিষয় নিয়ে পড়া ও পড়ানো দুটোই অপরাধ নয় কি? |
কিন্তু এ সব রসের কথা লিখতে ইচ্ছে করছে না। কারণ রায়ের খবর শোনার পর থেকে যা সত্যি করে আচ্ছন্ন করছে, তা হল ভয়। অসংখ্য মুখ মনে পড়ে যাচ্ছে, অসংখ্য বন্ধু, পুরনো বন্ধুর কথা। কেউ মাস্টার, কেউ ডাক্তার, কেউ সরকারি চাকুরে। দিল্লি হাইকোর্টের রায়ের পর যাঁরা প্রকাশ্যে এসেছেন, নিজের আইডেন্টিটি ঘোষণা করেছেন। ভয় লাগছে এঁদের সবার জন্য। হয়তো কেউ ফ্ল্যাট নিয়েছেন, কেউ বাড়ি ভাড়া করেছেন, একসঙ্গে আছেন, এ বার নতুন রায়ের বাহুবলে রাষ্ট্র আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা নতুন হিংসার ছক করবে না তো এদের বিরুদ্ধে? দুই মহিলাকে হাত ধরে ভরপুর হাঁটতে দেখলে অশ্লীলতার জিভ লকলক করবে না তো কিছু পথচারী ইভটিজারদের? কিংবা এর পর হয়তো হাত ধরে হাঁটাই ব্যান হয়ে যাবে নারী-নারীদের। শুধু মেয়েদের হাত ধরে হাঁটা ব্যান হবে কেন? নারী-পুরুষের প্রকাশ্যে হাত ধরে ঘোরাও ব্যান হয়ে যেতে পারে।
না, সুপ্রিম কোর্টের নবতম রায় হয়তো এ-রকম কিছু বলেনি, সমকামীদের জেলে পুরতে হুকুম দেয়নি, সমলিঙ্গের মানুষদের হাত ধরে হাঁটা ব্যান করেনি, কেবল এক বিশেষ ধরনের যৌন আচরণকে অপরাধ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া ভারতীয় দণ্ডবিধির একটি প্রাচীন ধারা বলবৎ রেখেছে মাত্র। কিন্তু অর্থনীতিতে একটি কথা আছে, ‘ট্রিকল ডাউন এফেক্ট’। এই রায়ের ট্রিকল ডাউন এফেক্ট-এ যদি সমকামী দম্পতিদের পাড়া থেকে উৎখাত হতে হয়, বেশি ‘বাড়াবাড়ি’ করলে পিংকি প্রামাণিক করে দেওয়ার হুমকি শুনতে হয়, সংখ্যাগুরুর ভাবাবেগকে প্রাধান্য দেওয়ার নামে যদি প্রান্তিক যৌনতার মানুষজনকে হেনস্থা করে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তার দায়িত্ব কার উপর বর্তাবে, জানার জন্য উচ্চতম আদালতের দিকে সাগ্রহ তাকিয়ে থাকলাম। বৃহত্তম গণতন্ত্রে বিচারব্যবস্থার উপর এটুকু প্রত্যাশা থেকেই যায়।
রাষ্ট্রকে যদি এক বার ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে পড়ার এক্তিয়ার দিতে থাকি, এর শেষ কোথায়, কেউ কি বলতে পারে? এলজিবিটি গোষ্ঠীর বেঁচে থাকা তছনছ করাতেই যে তার দাদাগিরি সীমিত থাকবে, তার কি কোনও নিশ্চয়তা আছে? আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত কোনও রুদ্ধদ্বার যাপনে কখন তার হঠাৎ আবির্ভাব হবে, তা কি আমরা নিজেরাই জানতে পারব? আদালত বলেছেন আইন সংশোধনের কথা ভাবতে পারে আইনসভা। ভয় হয়, সনাতন আইন বাতিল করে আরও সনাতন আইন ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ হবে না তো? যাতে ঠিক ঠিক মাপের ভারতীয়ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়?
তবে একটা মজার কথা হল এই যে, এই মৌলবাদলাঞ্ছিত দেশে এমনি সময়ে ধর্মে ধর্মে মিলমিশ হয় না, এ বলে ওকে মার তো ও বলে একে। সমকামীদের মারার বেলায় কিন্তু দেখা যাচ্ছে সব একজোট। দিল্লি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাঁরা মামলা করেছেন বা সমকাম অবৈধ সাব্যস্ত হওয়ার পরে যাঁরা পরিতৃপ্তি জানাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে সব ধর্মগুরুদেরই উপস্থিতি দেখছি। সমকামীদের যে মারাই উচিত, এতে ধর্মনির্বিশেষে গুরুরা একমত। হায়! কোনও ভাল কাজে এমন ঐকমত্য দেখালে এই হানাহানির দেশে না জানি কত ভালবাসার রুপোলি রেখা দেখা যেত!
তবু, ভেঙে পড়াটা কোনও কাজের কথা নয়। ভেঙে পড়বই বা কেন? অনেকে বলছেন, আন্দোলন অনেক পিছিয়ে গেল, ‘ওরা’ আর প্রকাশ্যে আসতে পারবে না, ইত্যাদি, আমার কিন্তু পুরোটা তা মনে হয় না। ধাক্কা একটু খেল সন্দেহ নেই, কিন্তু ২০০৯ দিল্লি হাইকোর্টের রায়ের জন্যই হোক আর দুনিয়া জুড়ে এলজিবিটি গোষ্ঠীর দৃশ্যমানতা বাড়ার ফলেই হোক, ভারতীয় নাগরিক মানসে এই অন্য রকম জীবনধারার প্রতি যে সহমর্মিতা, তার যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে, তা কি এত সহজে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে? গত কয়েক বছর পৃথিবী জুড়ে নিজের ভিন্ন-সত্তা প্রকাশ্যে আনার প্রবণতা বেড়েছে। এ দেশের মানুষ তার সঙ্গে তাল মিলিয়েছেন। দিল্লি হাইকোর্টের রায়ের পরে মূলস্রোতে অনেক বেশি শামিল হয়েছেন এঁরা। ১১ ডিসেম্বর ২০১৩ রায় বেরোনোর দিন রামধনু পতাকা নিয়ে প্রকাশ্যে সমবেত হওয়া মানুষজনই তার প্রমাণ। ‘সমকামিতা অপরাধ’ রায় জারি হওয়ার পরও তাঁরা মুখ ঢাকেননি, প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমের সামনে, এক পৃথিবী মানুষের সামনে জানিয়েছেন তাঁদের সুখ দুঃখ বেদনার কথা, তাঁদের অধিকার দাবির কথা। এবং তাঁরা ভয় পাননি। কারণ এত দিনে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার অভিজ্ঞতায় তাঁরা চেনে নিয়েছেন বন্ধু, ‘সাপোর্ট গ্রুপ’। তাঁরা জানেন, দিল্লি হাইকোর্টের রায় বেরনোর পর গত তিন-চার বছর ধরে মূলস্রোত সমাজের যে বিরাট অংশের সমর্থন তাঁরা পেয়েছেন, আজ তা হঠাৎ বদলে যাবে না। বরং এই সমর্থন নিয়েই তাঁরা এবং তাঁদের সহযাত্রী আরও বহু মানুষ নতুন রাজনীতি তৈরি করতে পারবেন, পার্লামেন্টের ভিতরে হোক বা বাইরে। তাঁরা জানেন, আমরাও জানি, নতুন রায় পুরনো রায়কে বাতিল বলতে পারে, কিন্তু তার সূদূরপ্রসারী প্রভাব মুছে দিতে পারে না।
রসায়নবিজ্ঞানে কিছু প্রতিক্রিয়া থাকে একমুখী, এক বার ঘটে গেলে আর আগের অবস্থায় ফেরানো যায় না কিছুতেই। জীবনেও তো তা-ই। তা সে সুপ্রিম কোর্টের রায় যা-ই বলুক না কেন। |