বিকল্প যৌনতার লড়াই যাঁরা লড়ছেন, তাঁদের পাশে থাকতেই হবে।
দাক্ষিণ্যবশত নয়, মহত্ত্বের সন্ধানেও নয়। স্বাধীনতার চাহিদায়।
লিখছেন সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় |
ছোড়দিদি, তোমার সেই মেয়েছেলের মতো ব্যাটাছেলে বন্ধুটা এয়েচে গো, তোমায় ডাকতেচে।’ ‘দ্যাখো মাসি, আমার বন্ধুকে এ রকম বলবে না। যদি নাম না জানো তো জিজ্ঞেস করে নেবে। কার হাবভাব কেমন সেটা তোমায় দেখতে হবে না’, ঝাঁঝিয়ে উঠলাম আমি।
এবং প্রথম ধাক্কাটা খেলাম। বাড়ির কেউ এক জন বলে উঠল, ‘দোষ তো ওর নয়। যে যেমন তাকে সে ভাবেই বর্ণনা করবে লোকে, তাই না? তুই গলা ফাটিয়ে হয়কে নয়, নয়কে হয় করলেই তো হবে না! গায়ের জোরে ধ্যানধারণা বদলানো যায় না।’ গলা ফাটিয়ে যুক্তি দিয়েছিলাম। এবং শেষ পর্যন্ত শুনতে হয়েছিল, ‘তোর কেন এত মাথাব্যথা ওদের জন্য? এত গা জ্বালা করছে কেন? তুইও কি তা হলে ওদের মতোই এক জন নাকি? তা হলে তো চিন্তার ব্যাপার। খতিয়ে দেখতে হয়।’
এ তো গেল বাড়ি। বাইরেও কিছু কম অপমান সহ্য করিনি। যখনই সমকামীদের হয়ে কথা বলেছি, তখনই, যাঁরা মনে করেন (এর মধ্যে শিক্ষিত প্রফেসার, নামজাদা ডাক্তার, বয়স্ক মেসোমশাই বা পিসেমশাই এবং আই আই এম শিক্ষিত তরুণ কপোর্রেট অফিসারও আছেন) যে সমকাম অপরাধ, অপ্রাকৃতিক, আমাদের শাস্ত্রে নেই, ওটা অনুচিত তখনই তর্কের শেষ ভাগে এসে আমায় খুব রেগেমেগে আক্রমণ করেছেন। আমার কেন ওদের প্রতি এত সহানুভূতি, কেন আমি ওদের হয়ে গলা ফাটাচ্ছি? তা হলে কি আমি আসলে নিজের যৌনপরিচয় লুকিয়ে রেখেছি? আমার সত্যিকারের ‘সাহস’ নেই বলে আমি ঘরোয়া আড্ডায় ওদের নাম করে নিজের ঝাল মেটাচ্ছি? |
এর পর আমি কেমন থম মেরে যাই। কী করে এদের বোঝাব, কোথা থেকে শুরু করব? অধিকারের লড়াই বা তার জন্য সমর্থন কি কখনও বেছে বেছে করা যায়? এটা তো মানবতাকে সমর্থন। মানবতার জন্য লড়াই। পিক অ্যান্ড চুজ মানবিকতা তৈরি করা যায় নাকি? কাস্টমাইজড মানবিকতা? দাঙ্গা হলে আমি অন্য ধর্মের হয়ে গলা ফাটাতে পারি, পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য গলা ফাটাতে পারি, ধর্ষণের বিরুদ্ধে গলা ফাটাতে পারি, কিন্তু আমি সমকামীদের জন্য গলা ফাটাতে পারি না। কেন? কারণ, তা হলেই সবাই আমায় সমকামী ভাবে। হঠাৎ সব কিছু ছেড়ে লোকের খুব মাথাব্যথা করে আমার যৌনপরিচয় নিয়ে। ‘আচ্ছা, ও যে তা হলে অমুককে বিয়ে করেছে, শুনেছি একটা বাচ্চাও আছে, সেটা কী করে সম্ভব?’ এবং অনেকে এর উল্টোটাও শুনেছেন, হলফ করে বলতে পারি।
অথচ কথাটা তো খুব পরিষ্কার: এই মেয়েটা বা ওই ছেলেটা, যারা বিসমকামী, তারা একটা মৌলিক অধিকারের জন্য লড়াই করছে, তারা দাবি করছে সমান অধিকার, তারা দাবি করছে যে, প্রত্যেক মানুষকে তাদের যৌন পছন্দ বেছে নিতে দেওয়া হোক। কে কার সঙ্গে এবং কী ভাবে যৌনতা করবে সেটাকে সমাজের মাপকাঠি হিসেবে, মানুষের মাপকাঠি হিসেবে, মানবতার মাপকাঠি হিসেবে ধরাটা কি এক রকম প্রতিবন্ধকতার নির্মাণ নয়?
যে বিসমকামীরা আজ সমকামীদের হয়ে লড়ছেন, তাঁদের অনেক কথা শুনতে হচ্ছে। হবেও। আসলে কোনও অন্যায় বা কোনও অধিকারের জন্য তো এমন কিছু মানুষকে লড়তে হবেই যাঁরা ওই অন্যায়ের শিকার নন, ওই অধিকার থেকে বঞ্চিত নন। কারণ আমি যে স্বস্তিকর পরিস্থিতিতে রয়েছি তার জন্য তো আলাদা করে লড়তে হচ্ছে না। যাঁরা সে-স্বস্তি পাচ্ছেন না তাঁদের জন্যই তো লড়াইটা প্রয়োজন। নানা অর্থে ‘অন্য রকম’ মানুষ সংখ্যালঘু, যৌনকর্মী, সমকামী, মানে যাঁদের নিয়ে আমাদের সমাজে ভীষণ সমস্যা, তাঁদের জন্যই তো লড়তে হবে। আর সেই লড়াইটাই কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যের জন্য সৎ চেষ্টায় লড়া খুব মূল্যবান। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমি বিসমকামী, আমি সমাজের একটা সুবিধেজনক জায়গায় থেকে একটা লড়াইয়ের কথা বলে ওদের তরিয়ে দিচ্ছি, দাক্ষিণ্য করছি। এমনটা যেন মনে না হয় যে, ‘আমি সমকামিতা সমর্থন করি, কিন্তু আমি বাবা সমকামী নই!’ কথাটা সোজা এবং সহজ। এই লড়াই যৌন-পছন্দ নির্বিশেষে কিছু মানুষের মৌলিক অধিকারের লড়াই।
আর অন্যের জন্য লড়া মানে কোথাও না কোথাও নিজের জন্যই লড়া। নিজের মেরুদণ্ডের ঋজুতার জন্য লড়া। প্রতিটি মৌলিক অধিকারের জন্য লড়া। প্রতিটি স্বাধীনতার জন্য লড়া। তা না হলে স্বাধীনতার মানে কী? আমার পছন্দের বৃত্ত, আমার স্বাধীনতার বৃত্ত তো বাড়াতেই হবে। যেখানে কোনও অস্বস্তি ছাড়াই ‘আমাদের’টাও থাকবে আবার ‘ওদের’টাও থাকবে। আর ‘ওদের’কে আমাদের বৃত্তে নিয়ে আসতে হলে আমাদের এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলতে হবে, তবেই তাতে অনেক মানুষ শামিল হতে পারবেন। তবেই প্রতিষ্ঠিত হবে যে, সাদা মানুষের পাশে কালো মানুষ থাকাটা যেমন স্বাভাবিক, তেমনই বিসমকামিতার পাশাপাশি সমকামিতাও স্বাভাবিক।
আসলে, আমরা, যারা ‘নর্মাল’, তারা ধরেই নিই যে আমরাই ঈশ্বরের সর্বোত্তম সৃষ্টি। বেঞ্চমার্ক। আর ইতিহাস বেয়ে আসা এই ভুল ধারণাই যেন অন্যের জীবন সম্পর্কে চূড়ান্ত রায় ঘোষণার এবং যাপনকে নিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ অধিকার দিয়ে দেয়। এই বেলা এ হেন সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স ত্যাগ দিলে ভাল হয় না কি? তা হলেই, যাঁরা ‘অন্য রকম’ বা ‘অ্যাবনর্মাল’ ছিলেন তাঁরা সাধারণ হবেন, নর্মাল হবেন। |