মালদহে এক জুয়াবিলাসী তাহার কন্যাকে বাজি ধরিল এবং হারিল। কাণ্ডটি ঘটিল বিশাল ভিড়ের সম্মুখে, সকলে মজা দেখিল, কেহ প্রতিবাদ করিল না। শুনিয়া অনেকের দ্রৌপদীর কথা মনে পড়িয়া গিয়াছে। সেই মহাকাব্যনায়িকা তবু তাত্ত্বিক প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন, এই মেয়েটি স্কুলে থাকাকালীন ‘পণ’ হিসাবে ব্যবহৃত হইয়াছে ও সম্পত্তি হিসাবে হস্তান্তরিত হইয়াছে, তাহার কিছু বলিবার থাকিলেও তাহা কেহ লিপিবদ্ধ করে নাই। মানুষ অন্য মানুষকে নিজ সম্পত্তি হিসাবে গণ্য করিতেছে দেখিয়া কেহ আঁতকাইয়াছেন, কিন্তু এই প্রবণতা বিরল নহে। কিছু দিন পূর্বে লন্ডন হইতে তিন জন ‘ক্রীতদাসী’কে উদ্ধার করা হইয়াছে, যাঁহারা তিরিশ বৎসর একটি গৃহে বন্দি ছিলেন। যদিও তাঁহাদের ‘নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা’ দান করা হইয়াছিল, প্রহার বা নিগ্রহ করা হইত না, তবু তাঁহারা এই দীর্ঘ সময় বহিঃপৃথিবী দেখেন নাই, পথে বাহির হন নাই। তাহা হইলে এত দিন অন্যের সাহায্য চাহেন নাই কেন? কারণ উঁহাদের হস্তে ‘অদৃশ্য হাতকড়া’ ছিল। আদর্শ দিয়া, এক প্রকার ‘দর্শন’ দিয়া মস্তিষ্ক প্রক্ষালন করিয়া, তাঁহাদের আনুগত্য নিশ্চিত করা হইয়াছিল। যে কোনও সমষ্টি যখন ‘কাল্ট’ হইয়া উঠিতে চাহে, তখন সদস্যদের হৃদয়ে সেই গোষ্ঠীর প্রধানের প্রতি এক নিঃশর্ত আনুগত্য ও নির্ভর, এবং সেই গোষ্ঠীর বাহিরে যে বিশ্ব তাহার প্রতি এক প্রবল ভীতি প্রোথিত করা হয়। এইগুলি মিলিয়া সদস্যদের শৃঙ্খলিত করিয়া ফেলে। সম্প্রতি দক্ষিণপশ্চিম ইংল্যান্ডের এক যাযাবর সম্প্রদায়ের কবল হইতে তিন জন ‘ক্রীতদাস’কেও উদ্ধার করা হইয়াছে। আর ভারতেই এই প্রকার একটি ঘটনায়, এক পরিচারিকা বলিয়াছেন, কর্ত্রী তাঁহাকে কখনও কখনও চার হস্ত-পদে সারমেয়সদৃশ ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া, কেবল মুখ ব্যবহার করিয়া খাইতে বাধ্য করিতেন। কেন? কারণ, মহিলা এই আমোদের উষ্ণতা পোহাইতেন: ব্যক্তিটির উপর তাঁহার নিয়ন্ত্রণ এমন প্রশ্নাতীত, তাঁহাকে মনুষ্যেতর প্রাণীর স্তরে নামাইয়া দিলেও প্রতিবাদ আসিবে না।
মানুষ সকল ছাড়িতে পারে, কিন্তু ক্ষমতার লোভ, অন্যকে পরাধীন রাখিবার লোভ ছাড়িতে পারে না। যে কপর্দকশূন্য, সেও গৃহে ফিরিয়া স্ত্রীকে প্রহার করে, বলে, যাহা বলিব তাহা করিবি। কারণ, সে এক জনকে চাহে, যে পূর্ণ রূপে তাহার সম্পত্তি। স্ত্রী রাগিয়া সন্তানকে এক চড় মারিয়া দেয়। সে মনে করে, শিশু তাহার সম্পত্তি মাত্র। আর যে মহান আবেগ লইয়া কোটি কোটি কাব্য রচিত, সেই প্রেমে আমরা কী বলিয়া থাকি? ‘তুমি আমার।’ প্রণয় প্রগাঢ় হইলে, প্রেমাস্পদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে হাত রাখিয়া বারবার জিজ্ঞাসা করি, ‘ইহা কাহার?’ সে গদগদ উচ্চারণে উত্তর দেয়, ‘কেবল তোমার।’ এই ভাবে, প্রণয়ীর দেহের প্রতিটি অঙ্গে নিজ মালিকানার ছাপ মারিয়া দিই। শরীরের মাধ্যমে সেই ছাপ মারিতে চাহি তাহার হৃদয়ে, সত্তায়। যখন সে অন্য কাহারও সহিত কথা বলে, ঈর্ষাজর্জর চিৎকার করি, ‘কী কথা তাহার সাথে?’ সে বিরক্ত হইবার পরিবর্তে প্রায়ই পুলকিত হয়, ভাবে, কী অশেষ প্রেম এই ‘দখলদারি’কে প্রণোদিত করিতেছে! ইহাতে তাহার প্রেমের গৌরব বর্ধিত হয়, সে নিজেকে অন্যের সম্পত্তি ভাবিয়া তৃপ্ত হয়। পিকনিকে কী পোশাক পরিয়া যাইবে, তাহাও সে ‘মালিক’টিকে জিজ্ঞাসা করিয়া লয়। অবশ্য আর কয় দিন পরে লোকটি যখন সন্দেহবশে তাহার টুঁটি মোচড়াইবে, তখন ছটফট করিতে করিতে তাহার মনে পড়িবে না, এই টুঁটি প্রকৃত প্রস্তাবে ‘অন্যের’। আমাদের অধিকাংশের এই অভীপ্সা রহিয়াছে: আমার নিকটস্থ সকল মানুষ: বন্ধু, প্রণয়ী, আত্মীয় নিজ মতামত বিলোপ করিয়া আমার নীতি ও দর্শনের নিকট আত্মবলি দিবে। আমার সম্পত্তি হইবে। এই সম্পত্তিগুলি ডাক্তারি পড়িবে কি না, তাহা আমরা বিনা আলোচনায় নিজেরাই ঠিক করিয়া দিই। তাহারা কাহাকে বিবাহ করিবে, আমরাই সিদ্ধান্ত লই। কেবল জুয়া খেলি না বলিয়া, সংবাদপত্র আমাদিগের সন্ধান সহজে পায় না। |