|
|
|
|
|
|
|
আপনার সাহায্যে... |
|
C/O হিপনোসিস
এখন কলকাতাতে। কখনও রোগ সারাতে। কিংবা শুধু উত্তেজনা নিতে।
এমনকী ‘পূর্বজন্ম’র কথা জানতেও। খোঁজ নিলেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় |
অন্ধকার ঘর। সরু সুতোয় বাঁধা একটা ছোট্ট চাকতি চোখের সামনে পেন্ডুলামের মতো দুলছে। “মুকু-উ-উ-ল, মুকু-উ-উ-ল, শুনতে পাচ্ছো? সোনার কেল্লা কোথায়? মনে পড়ছে? পড়ছে?”
হিপনোটাইজড মুকুলের নাম মনে পড়ে গিয়েছে! জয়-সল-মীর। নকল ডক্টর হাজরা-কে আর পায় কে! ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে দৌড়, দৌড় লুকনো গুপ্তধনের খোঁজে!
জব্বর একটা নাম, ‘সম্মোহন।’ হিপনোসিস!
হিপনোটিক থেরাপিতে শরীর ও মনের রোগ সারানো, পূর্বজন্মে ফিরে যাওয়া, স্পিরিট রিলিজ কেউ বলছেন ‘বৈজ্ঞানিক’, কারও কাছে আজগুবি, বুজরুকি, কেউ মনে করেন ব্ল্যাকম্যাজিক, আবার কারও ব্যাখ্যায় অর্ধেক সত্যি-অর্ধেক কল্পনা।
সত্যি-মিথ্যা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস মিলিয়েই চিকিৎসাশাস্ত্রে জায়গা করে নিয়েছে সম্মোহনবিদ্যা। পেয়েছে ‘অলটারনেটিভ সায়েন্স বা অলটারনেটিভ থেরাপি’-র মর্যাদা।
কলকাতা শহর পর্যন্ত এ হেন রহস্যময় বিদ্যার আকর্ষণ এড়াতে পারেনি। সরকারি হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগ হোক কিংবা বেসরকারি ইনস্টিটিউট, এ শহরে সম্মোহনচর্চা চলছে।
কলকাতার একাধিক হিপনোটিস্ট বা হিপনোথেরাপিস্টের দাবি, কাজটা ঠিকঠাক জানলে তা প্রয়োগ করে আর্থ্রারাইটিস, হাইপারথাইরয়েডিজম থেকে শুরু করে অ্যাজমা, ক্রনিক হজমের সমস্যা, মদ বা ধূমপান অভ্যাস, বন্ধ্যাত্ব, স্ট্রোকের ফলে হওয়া পঙ্গুত্ব, অ্যাংজাইটি, মাইগ্রেন, বাত বা ক্যানসারের যন্ত্রণা, অনিদ্রা, ফোবিয়া, উচ্চরক্তচাপ, ওজন বৃদ্ধিসমূলে মিটিয়ে দেওয়া যায়।
অবিশ্বাস করলে করতে পারেন। তখন হিপনোথেরাপিস্টরা টেবিল চাপড়ে বলবেন, “প্রেমে পড়াটা কী মশাই? সম্মোহনের এর থেকে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে? কাউকে দেখে মনে হয় যেন কত দিনের চেনা, যেন কোথায় দেখেছেন। কোনও জায়গা প্রথম বার চাক্ষুষ করেও মনে হয় যেন আগে কখনও এসেছেন। এটাও হিপনোসিস। কারও সঙ্গে কথা বলতে খুব ভাল লাগে বা কথা বলতে গিয়ে বারবার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান। হিপনোসিস!”
হালে গ্র্যান্ডমাস্টার বিশ্বনাথন আনন্দকে হারানো ২৩ বছর বয়সি বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনের সম্বন্ধে বলা হয়, তিনি নাকি তুখোড় হিপনোটিস্ট! খেলতে বসেই প্রতিপক্ষের চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁর মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেন! যে সে নন, এই অভিযোগ খোদ প্রবাদপ্রতিম দাবাড়ু ভিক্টর কোর্চনয়-এর। সেই কারণেই নাকি সেপ্টেম্বরে কার্লসেনের বিরুদ্ধে কালো চশমা পরে খেলতে বসেছিলেন আমেরিকার গ্র্যান্ডমাস্টার হিকারু নাকামুরা।
কলকাতায় গত প্রায় ২০ বছর ধরে হিপনোসিস নিয়ে কাজ করা অমিতাভ মুখোপাধ্যায় এর মধ্যে অবিশ্বাসের কিছু দেখেন না। “আফটারঅল, মানুষের মস্তিষ্কের থেকে শক্তিশালী কিছু নেই। আর কোনও মানুষের মস্তিষ্কের জোর অন্য মানুষের চেয়ে বেশি হলে সে অন্যকে বাগে আনতে চাইবে। হিপনোসিসের মাধ্যমে সেটা বৈজ্ঞানিক ভাবে সম্ভব।”
আইন পাশ করার পর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট’ (জোকা) থেকে সত্তরের দশকে ‘বিহেভিয়ারাল সায়েন্স’-এ এমবিএ করেন অমিতাভবাবু। তাঁর কাছে হিপনোসিস হল ‘অলটার্ড স্টেট অব মাইন্ড।’ দাবি করেন, স্রেফ কথা বলে লোককে হিপনোটাইজ করে তিনি শারীরিক স্থূলতা-র মতো সমস্যার সমাধান করতে পারেন! কী ভাবে?
“খুব সহজ। স্রেফ কথার মাধ্যমে হিপনোটাইজ করে আমি এমন একটা ধারণা ঢুকিয়ে দিই যাতে তাঁর মনে হতে থাকে যে তাঁর পাকস্থলীটা ছোট হয়ে গিয়েছে। যেমন অনেকটা বেরিয়াট্রিক সার্জারি করালে হয়। তাতেই তাঁর খাওয়া কমে যায়। তাঁর ওজন কমে!”
শুধু তিনি একা নন, কলকাতার ‘হিপনোসিস বিশেষজ্ঞ’-দের কারও দাবি, তাঁরা মানুষকে তাঁর পাঁচ জন্ম আগে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ধরেন!
কেউ আবার বুক ঠুকে বলেন, “আত্মার ওজন মেরেকেটে ২১ গ্রাম! হিপনোসিসের মাধ্যমে দেহ থেকে আত্মা বার করে নেড়েঘেঁটে দেখে, আবার শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়!” |
কোথায়, কী ভাবে |
কারা এই থেরাপি করতে পারেন |
আইনানুযায়ী শুধুমাত্র যে কোনও বিভাগের চিকিৎসকেরাই প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করার জন্য স্বীকৃত। কিন্তু আইন না মেনে অনেকেই ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা নেন এবং প্র্যাকটিসও করেন। রোগীর ক্ষেত্রে এটা ক্ষতিকর। ভারতে গুজরাতের বরোদা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সোসাইটি ফর ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল হিপনোসিস, ইন্ডিয়া’-র সহযোগিতায় সরকার স্বীকৃত একটি পিজি ডিপ্লোমা কোর্স চালু রয়েছে। |
কোথায় এই চিকিৎসা পাওয়া যায় |
ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রি-তে। এ ছাড়া একাধিক বেসরকারি সাইকিয়াট্রিস্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট হিপনোসিস প্র্যাকটিস করেন। |
কত টাকা লাগে |
প্রতি সেশন মোটামুটি ৮০০-২০০০ টাকা। আর হিপনোসিস শিখতে ৫০-৭০ হাজার টাকা নেয় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। |
|
কারও দাবি, স্রেফ কথার মাধ্যমে হিপনোটাইজ করে টিউমার মিলিয়ে দিয়েছেন, আবার কেউ গল্প শুনিয়েছেন হিপনোসিস থেরাপি-র মাধ্যমে শিরদাঁড়ার ভাঙা হাড় জোড়া লাগানোর! বিশ্বাস করলে করতে পারেন, আবার অবিশ্বাস করাটাও জন্মসিদ্ধ অধিকার।
সমস্যার সুরাহা পেতে এ শহরের এক-একজনে হিপনোটিস্টের কাছে মাসে প্রায় ১০-১৫ জন করে রোগী আসেন। তাঁদের কেউ খেলোয়াড়, বহুজাতিক সংস্থার কর্মী, অভিনেতা, অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, সেলস রিপ্রেজেনটেটিভসকলেই আছেন। বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থা, স্কুল এবং কলেজ আবার কর্মী-ছাত্রছাত্রীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ‘গ্রুপ হিপনোটিজম’ সেশন আয়োজন করাচ্ছে।
অনবরত উত্তেজনা খোঁজা এখনকার প্রজন্মের অনেকে নিছক অ্যাডভেঞ্চার-এর জন্যও আসেন। যেমন এসেছিলেন নিউ আলিপুরের বছর বত্রিশের অবিবাহিতা যুবতী। বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। নামটা ওঁর অনুরোধে উহ্য থাক। বন্ধুর কাছে শুনে মজা করার জন্য ‘পাস্ট লাইফ রিগ্রেশন’ করিয়েছিলেন। বাংলায় যাকে বলা হয়, গতজন্মে ফেরা।
তাঁর কথায়, “থেরাপিস্ট প্রথমে রিল্যাক্স করে বসতে বললেন। ঘর নিস্তব্ধ। চোখ বন্ধ করে কোনও একটা বিষয়ের উপর আমাকে কনসেনট্রেট করতে বলা হল। একটা প্রদীপের শিখা ভাবতে চাইলাম। কিন্তু মনের মধ্যে তখন যেন হাজারটা বাঁদর নাচছে। ভয়-ভয়ও করছিল। একটা সময় কেমন যেন ভাসতে লাগলাম। তার পর আর আমার হুঁশ নেই। কিন্তু সেই অবস্থায় যা বলেছিলাম তা টেপ করা আছে।”
হিপনোটাইজড অবস্থায় ওই তরুণী জানিয়েছিলেন, তিনি গত জন্মে ময়মনসিংহের এক জমিদারের আদরের একমাত্র মেয়ে ছিলেন। কিন্তু বাবা-র ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্নবীদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় বাবা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্রী করেন। তিনি ঘর ছাড়েন। দীর্ঘদিন জেলে থাকেন। শেষ বয়সে ময়মনসিংহে অনাথ আশ্রম করেছিলেন। সেখানে সবাই তাঁকে বুড়িমা বলে ডাকতেন।
এর পর আরও চমক। যুবতী জানান, “বিশ্বাস-অবিশ্বাসের অদ্ভুত দোলাচলে চলে গেলাম। ময়মনসিংহের যে জায়গার কথা বলেছিলাম, সত্যিই ওই অনাথ আশ্রম খুঁজে পেলাম। সে বছর তিনেক আগের কথা। মাথা ঘুরে গিয়েছিল। দেখলাম সেখানে তখনও বুড়িমা-র ছবি টাঙানো! ওখানেই বাকি জীবন কাটাব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু বাবা-মা কেঁদেকেটে হাতেপায়ে ধরে ফেরত আনলেন। সে সব ভুলে থাকার চেষ্টা করছি।” বিশ্বাস করতে পারেন, আবার অবিশ্বাসও।
হোমিওপ্যাথির চিকিৎসক কলকাতার দেবেন্দ্র পাণ্ডে এক যুগের বেশি সময় ধরে হিপনোসিস প্র্যাকটিস করছেন এই শহরে।
দেবেন্দ্র বোঝান, “যখন মানুষ হিপনোটাইজড অবস্থায় থাকে তখন তাঁর দেহ ঘুমিয়ে থাকে, কিন্তু মস্তিষ্ক জাগে। অনেকটা তন্দ্রাচ্ছন্ন বা মদ খেয়ে অর্ধচেতন হয়ে যাওয়ার অবস্থার মতো। তখন মনের গহনে বহু বছর এমনকী মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অনেক অভিজ্ঞতা সে বলে দিতে পারে। মানুষের মনের ‘কনশাস’ অংশ মাত্র ১৮ শতাংশ। বাকিটা ‘আনকনশাস’ বা অবচেতন। এই দু’টো অংশের মধ্যে একটা গাঢ় অন্ধকারের পর্দা থাকে। দক্ষ হিপনোটিস্টরা এই পর্দা পার করে মানুষকে অবচেতন অংশে নিয়ে যেতে পারেন। আর তাতেই কেল্লা ফতে। তবে রোগী বা ‘সাবজেক্ট’-এর সাহায্য বা বিশ্বাস না পেলে জোর করে তাঁকে হিপনোটাইজ করা যায় না।”
বিচিত্র সব ‘কেস’-এর কথা শোনাচ্ছিলেন দেবেন্দ্র!
লেকটাউনের এক ভদ্রমহিলার ‘অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার’ ছিল। ভদ্রমহিলার সব সময় মনে হত, তাঁর গায়ে ময়লা লেগে আছে। রোজ সকাল সাড়ে আটটায় বাথরুমে ঢুকতেন আর বেরোতেন বেলা সাড়ে তিনটের সময়। দু’বছর ধরে সেশন চালিয়ে এখন ভদ্রমহিলা মাত্র দেড় ঘণ্টা বাথরুমে সময় দেন।
কলকাতার ‘ক্যালিফোর্নিয়া হিপনোসিস ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া’-র একটি কেসের কথা বলা যাক। বছর ছাব্বিশের একটি মেয়ে। ভারতীয়, আপাতত লন্ডনে থাকেন। তাঁর হাঁফানির এত বাড়াবাড়ি রকমের যে দিনে ২০ বার পাফ নিতে হত।
হিপনোটাইজ করে জানা গেল, কলেজের হস্টেলে র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছিলেন তিনি। উঁচু ক্লাসের মেয়েরা তাঁকে একদিন বাথটবের জলে চেপে ধরেছিলেন। সেই সময় মারাত্মক দমের কষ্ট হয় তাঁর। মনে সাঙ্ঘাতিক ক্ষত তৈরি করেছিল সেই অভিজ্ঞতা। ওই মুহূর্তের কথা যত বার মনে পড়ত, তত বার তাঁর শ্বাস আটকে যেত। মনে জমে থাকা এই অভিজ্ঞতা হিপনোসিসের মাধ্যমে বলে দেওয়ার পরেই তাঁর অ্যাজমা কমে যায়।
এসএসকেএম হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট তথা ‘সোসাইটি ফর ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল হিপনোসিস, ইন্ডিয়া’-র অন্যতম প্রধান প্রশান্ত রায়। তাঁর দাবি, “হিপনোসিস অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি। এর মধ্যে অবাস্তব-ভুতুড়ে কিছু নেই। আসলে মানুষের অনেক অবদমিত বিশ্বাস বা ভাবনা থাকে। তার থেকে মানসিক রোগ হতে পারে। হিপনোটাইজড অবস্থায় সে এমন অনেক ঘটনার কথা বলে যার পুরোটাই তার ‘ফলস মেমারি’। কিন্তু সেটা বলে ফেলার ফলে মনের ভার কেটে যায় এবং সেই মানুষ মানসিক ভাবে সুস্থ হয়ে যায়।”
এখন প্রশ্ন থাকতেই পারে, যাঁরা হিপনোসিস করেন, অর্থাৎ হিপনো বিশেষজ্ঞ, তাঁদের এই থেরাপি করতে গিয়ে কী ধরনের শারীরিক-মানসিক অনুভূতি বা ধকল হয়? অমিতাভবাবুর বক্তব্য, “কিছুই হয় না! মানসিক ভাবে হুঁশিয়ার, শক্তিশালী, সচেতন থাকতে হয়, ব্যস। ট্রেনিংটাই এমন হয় যাতে আমাদের কোনও চাপ থাকে না।”
প্রশান্তবাবুও বলেন, “রোগীরা পরে অনেক সময় বলেন, ‘গা শিরশির করছিল, কানে ভোঁ-ভোঁ লাগছিল, মনে হচ্ছিল শূন্যে ভাসছি।’ আমাদের এ সব কিছু হয় না।”
পণ্ডিতেরা তো বলেই গিয়েছেন ‘মনের গতি দুর্দমনীয়।’ তার তল পাওয়াও সহজ নয়। মন নিয়ে তাই টানাহ্যাঁচড়া, নাড়াঘাঁটা চলতেই থাকে। চলে বিজ্ঞান-অবিজ্ঞান তর্জা। সম্মোহনী মায়াজাল কতটা বিস্তার করা যায় তা নিয়ে থিওরি ভার্সেস থিওরির লড়াই। তা-ও মনখননের যাবতীয় উত্তেজনা নিয়ে চলতে থাকে হিপনোসিস।
বলা যায় না, কোন মুকুলের আবার সোনার কেল্লা-র ঠিকানা মনে পড়ে যায়! |
|
|
|
|
|