তখন দুপুর দুটো। স্ত্রী শেফালি বিবি ও তিন বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে মহদিপুর সীমান্তে ঢুকে চেকপোস্টের সামনে ধপ করে বসে পড়লেন বাংলাদেশের ভোলাহাটের লছমন শেখ। দম নিয়ে বলেন, “রবিবারের মধ্যে চেন্নাই পৌঁছতে হবে। স্ত্রীর অপারেশন আছে।” জানান, কাদের মোল্লার ফাঁসির পরই জামাতিরা রাস্তা কেটেছে। গাড়িতে আগুন ধরিয়েছে। “রাতে হেঁটে রওনা দিয়েছিলাম। আমবাগান, ধানের জমি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটু আগে সোনা মসজিদ সীমান্তে পৌঁছেছি,” বলেন লছমন।
মালদহের মহদিপুর সীমান্ত দিয়ে সাধারণত দিনে ৩০-৪০জন এপারে আসেন। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত এসেছেন ছয় জন। তাঁদের এক জন এ পারের বাসিন্দা মহম্মদ সরফরাজ নওয়াজ। জামা-কাপড়ের ছোট ব্যবসায়ী। বলেন, “আরও এক সপ্তাহ বাংলাদেশে থাকার কথা ছিল। কিন্তু কাদের মোল্লার ফাঁসির পর যা অবস্থা দেখছি, আর ঝুঁকি নিইনি।” কী সেই দশা? ওপারে সোনা মসজিদ। জামাত ও বিএনপির সমর্থকরা পাঁচ-ছয় ফুট গভীর করে রাস্তা কেটে দিয়েছে, যাতে গাড়ি কোনও মতেই না আসতে পারে। রাস্তায় গাছ ফেলা হয়েছে। টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। জ্বলছে গাড়িও। “অন্য বার যে রাস্তা গাড়িতে আধঘন্টায় এসেছি, খালবিল ধরে এ বার প্রায় পাঁচ ঘণ্টা হেঁটে তা পেরোলাম,” বললেন সরফরাজ। |
এ দিন অন্যান্য সীমান্তে বাণিজ্য বন্ধ হলেও, চ্যাংরাবান্ধাতে চালু ছিল। বেলা ১২টা নাগাদ ঢাকার গাবতলি থেকে সুতির কাপড়, তুলো বোঝাই ত্রিশটি ট্রাক ভারতে ঢোকে। চালক মহম্মদ রহিম, আইনুল হক, মহম্মদ ইকবাল, ইসাক হোসেনরা জানান, ক’দিন ধরে কয়েক কিলোমিটার এগোতে না এগোতে ফোনে আগুন, লুটপাটের খবর পেয়েছেন। ভয়ে সেখানেই তাঁরা আশ্রয় খুঁজেছেন। রহিম বলেন, “রাতে বুড়িমারি টার্মিনালে শুনি কাদেরের ফাঁসি হয়েছে। পাটগ্রাম, হাতিবান্ধায় দোকানে হামলা হচ্ছে। ভারতে পৌঁছনো যাবে কি না, চিন্তায় পড়েছিলাম।”
বাংলাদেশের নিলফামারি থেকে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন স্কুল শিক্ষক সফিয়ার ইসলাম। চিকিৎসার জন্য চেন্নাইয়ে যাবেন। সফিয়ার সাহেব বলেন, রাস্তায় বাস, ট্যাক্সি, রিকশা নেই। বন্ধের চেহারা নিয়েছে। যাতায়াতের একমাত্র ভরসা ট্রেন, সেও কতক্ষণ চলবে বলা যাচ্ছে না।
বসিরহাটের ঘোজাডাঙা সীমান্তে দেখা গেল, ভোর রাতে উঠে শহর এড়িয়ে গ্রামের মধ্যে দিয়ে মানুষ আসছেন ভারতের সীমান্তে। কাশিবাটি গ্রামের বাসিন্দা শঙ্কর সরকার বললেন, “বাংলাদেশের অবস্থা ভয়ঙ্কর। পারুলিয়া, দেভাটা, গাজিরহাট গ্রামে এক দল লোক বাড়ি বাড়ি লুটপাট চালাচ্ছে। অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে যাচ্ছে।” এ দিন দুপুর ১টা পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৭২ জন ঘোজাডাঙা দিয়ে এ দিকে আসেন। অনেকেই জানান, কলোরোয়া, বাকহাটি, আগরদাড়ি, কালীগঞ্জ, নলতা, পারুলিয়া, দেভাটা, ভোমরার অনেক জায়গায় দোকানপাট ভাঙচুর হয়েছে। রাজনৈতিক হানাহানিও চলছে। গ্রামের রাস্তা দিয়ে মোটরবাইক ছাড়া কোনও গাড়ি চলছে না। সাতক্ষীরার বাদামতলা, চৌমহনিতে ওষুধের দোকানেও হামলা হয়েছে।
অশান্তি হচ্ছে জেনে বাংলাদেশে পরিবারের কাছে ফিরতে উদগ্রীব অনেকে। এ দিন তাঁদের লম্বা লাইন পড়ে পেট্রাপোলে। ফরিদপুরের মহম্মদ আলি, খুলনার দীনেশচন্দ্র বিশ্বাস, ঢাকার প্রসেনজিৎ হালদার, সোনাবাড়ির বাবু গাজি, সবাই ফোনে ঘন ঘন খোঁজ নিচ্ছিলেন, বাড়ির কী অবস্থা। ঢাকার এক ব্যবসায়ী বললেন, “শুনছি গাড়ি চলছে না। কী করে ফিরব জানি না।” ওপার থেকে খবর আসছে, কুষ্টিয়াতে রেল লাইন অবরোধ হচ্ছে। পেট্রাপোলে আসতে হলে মোটরবাইক ভাড়া করা ছাড়া উপায় নেই। ঢাকা থেকে কয়েক জায়গায় ফেরিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
কলকাতার বেহালার বাসিন্দা শিবু কর্মকার জানান, ঢাকা থেকে বাসে সীমান্তে আসতে চার-পাঁচ ঘণ্টা বাড়তি সময় লাগছে। কারণ রাস্তায় অবরোধ চলছে। কোনও মতে রাস্তার একপাশ দিয়ে গাড়ি চলছে। অনেকেরই শঙ্কা, এখনও বিচ্ছিন্ন ভাবে অশান্তি হলেও, পরে তা আরও সংগঠিত বিক্ষোভের চেহারা নিতে পারে। |