একাত্তরে গণহত্যার নায়ক কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেওয়ার পরে কাল উৎসবের রাত কাটিয়েছে বাংলাদেশ। তার পর সকাল থেকেই জামাতে ইসলামির তাণ্ডবে কার্যত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে গোটা দেশ। দুপুরের পরে সেই তাণ্ডব মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকায় একমাত্র রেল পরিষেবা কিছুটা সচল ছিল। এ ছাড়া রাস্তা কেটে, গাছের গুঁড়ি ফেলে সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দিয়ে দলের নেতাকে ফাঁসি দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছে জামাতে ইসলামি ও তার ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র শিবিরের কর্মীরা। এর মধ্যেই রাজনৈতিক সঙ্কট কাটাতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদ্যোগ চোখে পড়েছে। রাজধানী ঢাকার একটি বাড়িতে বৈঠকে বসেছিলেন আওয়ামি লিগ ও বিএনপি-র মহাসচিবেরা। নির্বাচনী সরকার নিয়ে দু’পক্ষই একে অন্যকে কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। বিবেচনার পরে তা নিয়ে আবার বৈঠকে বসার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন শাসক ও বিরোধী দলের নেতারা।
কাল সারা রাত বাজি পুড়েছে ঢাকায়। বড় রাস্তা থেকে গলি পরিক্রমা করেছে স্বতঃস্ফূর্ত মশাল মিছিল। ‘মিরপুরের কসাই’ কাদের মোল্লাকে সত্যিই ফাঁসি দেওয়া হয়েছে এই খবর শোনার পরে আত্মহারা হয়ে পড়েন মানুষ। আনন্দে চোখের জলে ভেসে যান শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের সদস্যরা। কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতেই তাঁরা এই অবস্থান শুরু করেছিলেন। নতুন প্রজন্মের এই প্রতিনিধিরা শুক্রবার শপথ নেন, জামাতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ না-করা পর্যন্ত তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাবেন। |
তাণ্ডব। ঢাকার রাস্তায় জ্বলছে গাড়ি। শুক্রবার। ছবি: এপি। |
রীতিমতো লিখিত বিবৃতি দিয়ে প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছিল জামাত। শুক্রবার সকাল থেকেই যে তাদের হিংস্র আক্রমণ বাড়বে, তা আঁচ করা গিয়েছিল। কিন্তু সাতক্ষীরা বা বগুড়ার মতো নিজেদের ঘাঁটি এলাকাতেই সকালে তা সীমাবদ্ধ ছিল। বগুড়ায় একটি পরিবহণ সংস্থার গ্যারাজে আগুন ধরিয়ে দেওয়ায় ৪৮টি আধুনিক বাস ভস্মীভূত হয়ে যায়। শেরপুরে একটি বাজার জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সাতক্ষীরার কলারোয়ায় আওয়ামি লিগের দুই স্থানীয় নেতাকে ঘিরে ধরে পিটিয়ে মারে জামাত কর্মীরা। বহু বাড়ি ঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে। পেট্রোল বোমায় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে জয়দেবপুর রেল স্টেশনে স্টেশনমাস্টারের ঘর। কিন্তু দুপুরের পর এই ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তা কেটে, বড় বড় গাছের গুঁড়ি রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আটকে পড়া শতাধিক যানবাহনও।
সকাল থেকে রাজধানী ঢাকার মোড়ে মোড়ে এলোপাতাড়ি বোমা ছোড়া হচ্ছিল। কিন্তু দুপুরের পরে জামাত-শিবিরের সঙ্ঘবদ্ধ গুন্ডামি আতঙ্ক ছড়ায়। একের পর এক গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। হরতাল-অবরোধে বাৎসরিক পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় আজ শুক্রবার ছুটির দিনেও নানা স্কুলে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছিল। সেই সব স্কুলের সামনেই সব চেয়ে বেশি গুন্ডামি ও বোমাবাজি করে জামাত-শিবিরের কর্মীরা। ভাঙচুর করা হয় অন্তত ৪০টি মোটরগাড়ি।
নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে রাষ্ট্রপুঞ্জের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্ডেজ তারানকো যে আলোচনা প্রক্রিয়া শুরু করে গিয়েছিলেন, তার রেশ ধরে এ দিনও ফের একান্ত বৈঠকে বসেন শাসক আওয়ামি লিগ ও বিরোধী বিএনপি-র মহাসচিবেরা। দু’দলের অন্য গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও হাজির ছিলেন সেখানে। প্রকাশ্যে কোনও পক্ষই আলোচনার গতিপ্রকৃতি নিয়ে কথা না বললেও দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ফের বৈঠকে বসতে চলেছেন তাঁরা। নির্বাচনী সরকার নিয়ে দু’পক্ষই কিছু প্রস্তাব দেয় বৈঠকে। সেগুলো নিয়েই পরের বৈঠকে আলোচনা হবে।
এ দিকে মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল আজই। তবে আওয়ামি লিগ ও বিএনপি-র বোঝাপড়া হলে অবশ্যই নির্বাচনের নতুন নির্ঘণ্ট ঘোষিত হবে। তার আগে জাতীয় পার্টির নেতা এরশাদকে নিয়ে নাটকের পর নাটক চলছে। তিনি নির্বাচন থেকে সরে আসার কথা ঘোষণা করলেও দলে একচ্ছত্র প্রভাবশালী তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ সেই সিদ্ধান্ত মানছেন না। কাল রাতে বেগম রওশন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার পরেই এরশাদকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় র্যাব। দলের সূত্রে ঘোষণা করা হয়, সরকার তাঁকে আটক করেছে। কিন্তু র্যাব জানায়, অসুস্থ বোধ করায় তাঁকে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে সেনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতাল থেকে এরশাদ সকালে জানান, তিনি নির্বাচন না করার সিদ্ধান্তে অনড়। তাঁকে আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু বিকেলে বেগম রওশন তা অস্বীকার করেন। এ দিকে এই নাটকের মধ্যে, তিনি মুখে যা-ই বলুন, তিনটি আসনে এরশাদের প্রার্থীপদ কিন্তু রয়েই গেল।
|