হলদিয়া বন্দরের নাব্যতা কমে যাওয়া, উত্তরবঙ্গে রাস্তা খারাপ বলে পরিবহণ সংস্থাগুলির ট্রাক চালাতে অনীহা, বটলিং প্লান্টে কর্মী আন্দোলন এ সবের প্রভাবই এ বার এ রাজ্যের গৃহস্থের হেঁশেলে।
কয়েক মাস আগেও রান্নার গ্যাস ‘বুক’ করার পরে দু’তিন দিনের মধ্যেই গ্রাহকেরা তা পেয়ে যেতেন। কিন্তু অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে সিলিন্ডার পেতে এখন দু’তিন সপ্তাহ গড়িয়ে যাচ্ছে। কোনও কোনও গ্রাহক আবার মাসখানেক পরেও হা-পিত্যেশ করে বসে থাকছেন কখন ডেলিভারি বয় গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে দরজায় পা রাখবে। শীতে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ১০% বাড়ে। ফলে জোগানে ঘাটতি আরও দ্রুত হারে সমস্যা বাড়াচ্ছে। প্রসঙ্গত, ৩টি সংস্থা মিলিয়ে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নভেম্বরে এলপিজি-র চাহিদা ৭৫ হাজার টন।
তেল সংস্থাগুলির অভিযোগ, হলদিয়া বন্দরের নাব্যতা কমে যাওয়ায় বেশ কয়েক দিন এলপিজি ঢুকতে পারেনি। তারই জেরে টান পড়েছে রান্নার গ্যাস সরবরাহে। যার ফল ভুগতে হচ্ছে গ্রাহকদের। নতুন করে ফের কোনও সমস্যা না-হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও ১০-১৫ দিন সময় লাগবে বলেই ধারণা তাদের।
অন্য দিকে, একটি তেল সংস্থার দাবি, রাস্তার বেহাল দশায় উত্তরবঙ্গে সিলিন্ডার পাঠানোর জন্য ট্রাক চালাতে চাইছে না কোনও পরিবহণ সংস্থা। সংস্থাটির এক কর্তা জানান, তাঁদের পূর্ণিয়ার বটলিং-প্লান্ট থেকে উত্তরবঙ্গে সিলিন্ডার পাঠানো হয়। কিন্তু পরিবহণ সংস্থাগুলি জানিয়েছে, তারা বিহারে গ্যাস সরবরাহ করতে রাজি। কিন্তু উত্তরবঙ্গে নয়। কারণ সেখানকার রাস্তা অত্যন্ত খারাপ।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তেল সংস্থাগুলির নিজস্ব শোধনাগার থেকে যে-গ্যাস সরবরাহ করা হয় তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। তাই দেশের বাজারে চাহিদার প্রায় ৩৫% বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। দেশের বিভিন্ন বন্দরে জাহাজ থেকে ট্যাঙ্কারে করে সেই তরল গ্যাস আনা হয় সংস্থার বটলিং প্লান্টে। সেখান থেকে সিলিন্ডারে ভরে ডিস্ট্রিবিউটরদের সরবরাহ করে সংস্থাগুলি। হলদিয়ার বটলিং প্লান্ট থেকে ইন্ডিয়ান অয়েল (আইওসি), হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়াম (এইচপিসি) ও ভারত পেট্রোলিয়াম (বিপিসি) সিলিন্ডার সরবরাহ করে।
সরবরাহের সমস্যায় আরও ইন্ধন জুগিয়েছে কর্মী আন্দোলন। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, কয়েক মাস ধরেই কর্মী ইউনিয়নের একাংশের সঙ্গে বেতন সংক্রান্ত বিরোধে সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছিল বজবজে আইওসি-র বটলিং প্লান্টে। আপাতত রফাসূত্র মিললেও এখনও সমস্যা পুরোপুরি মেটেনি বলেই খবর।
এ দিকে হলদিয়া বন্দরের নাব্যতা কমে যাওয়ায় ইন্ডেনের সঙ্গে সঙ্গে টান পড়ে অন্য দুই সংস্থার সরবরাহেও। তেল সংস্থা সূত্রের খবর, গত মাসের শেষের দিকে কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় জাহাজ চলাচলে প্রভাব পড়েছিল। এরপর সাগর থেকে হলদিয়া বন্দরের প্রায় ১৬৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীপথের নাব্যতা নেমে আসে ৬.৬ মিটারে, যেখানে জাহাজ চলাচলের জন্য ন্যূনতম নাব্যতা ৭ মিটার। ফলে একটি করিডর দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকে কয়েক দিন। সাধারণ ভাবে তিন দিন অন্তর এলপিজি নিয়ে জাহাজ আসে হলদিয়া বন্দরে। কিন্তু করিডর বন্ধ থাকায় এই সময়ে অন্তত তিনটি জাহাজ কম আসায় সম্প্রতি প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিক টন এলপিজি কম এসেছে। এরপর করিডর খুলে গেলে আবার বন্দরে জাহাজের ভিড় বেড়ে যায়। ফলে পরের জাহাজগুলির আসাও পিছিয়ে যায়। তাই সরবরাহ বাড়লেও ঘাটতি পূরণ হতে সময় লাগছে। বিশাখাপত্তনম বা উত্তরপ্রদেশের আউরিয়া থেকে সরবরাহ বাড়িয়েও সেই ঘাটতির বেশিটাই সামলানো যায়নি।
অল ইন্ডিয়া পেট্রোলিয়াম ডিস্ট্রিবিউটর্স অ্যাসোসিয়েশনের অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদক বিজন বিশ্বাস-এর অভিযোগ, গ্যাস পৌঁছতে গড়ে ১৫-২০ দিন সময় লাগছে। যদিও তেল সংস্থাগুলির দাবি, এই সঙ্কট সাময়িক এবং জায়গা বিশেষে পাঁচ দিন থেকে দু’সপ্তাহের মধ্যে তারা গ্রাহকদের কাছে গ্যাস পৌঁছে দিচ্ছে।
ওড়িশার পারাদীপে ইন্ডিয়ান অয়েলের একটি শোধনাগার ও পৃথক টার্মিনাল চালু হলে হলদিয়া বন্দরের উপর চাপ কমবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। আইওসি সূত্রের খবর, আগামী অর্থবর্ষের গোড়ায় ওই শোধনাগারটি চালু হওয়ার কথা। বছর খানেকের মধ্যে টার্মিনালটি। এ ছাড়া বছর দুয়েকের মধ্যে পাইপলাইনের মাধ্যমেও এ রাজ্যের বিভিন্ন বটলিং প্লান্টে গ্যাস সরবরাহ শুরু হওয়ার কথা। সে ক্ষেত্রে হলদিয়া বন্দরে নাব্যতার সমস্যা থাকলেও পরিস্থিতি এতটা খারাপ হবে না বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। |