লালবাতি নিয়ে রায়ে সুবিধেই দেখছেন মমতা, তবুও সংশয়
সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ মহলে বলছেন, এই রায়ের ফলে রাজ্যে তালিকার বাইরে কেউ লালবাতি ব্যবহার করছেন কি না, তা খতিয়ে দেখার সুযোগ পাওয়া গেল। রাজ্য প্রশাসনের কর্তারাও জানাচ্ছেন, তালিকার বাইরে যাঁরা লালবাতি ব্যবহার করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। কিন্তু তার পরেও লালবাতি ঘিরে যথেচ্ছাচার কমবে কি না, তা নিয়ে সংশয় কাটছে না সংশ্লিষ্ট মহলের। কারণ, সাত মাস আগে হাইকোর্ট লালবাতির যথেচ্ছ ব্যবহার রুখতে কলকাতা পুলিশকে কড়া হওয়ার নির্দেশ দিলেও এখনও এক জনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
রাজ্যে এখন গাড়িতে লালবাতি লাগাতে পারেন এমন পদের সংখ্যা প্রায় ৫০। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মানলে তা কমে কুড়ির কাছাকাছি চলে আসবে। কিন্তু ঘটনা হল, রাজ্যের তালিকার বাইরেই বহু পদাধিকারী, এমনকী কোনও পদে আসীন না-থেকেও অনেকে নির্বিচারে লালবাতি ব্যবহার করেন। এঁদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। তার পরেও তারা নড়েচড়ে বসল না কেন?
পুলিশের বক্তব্য, বেআইনি ভাবে কেউ লালবাতি কিংবা ফ্ল্যাশার-সহ (গাড়ির উপরে ঘুরন্ত বাতি) লালবাতি গাড়িতে লাগিয়ে ঘুরছেন, এমন অভিযোগ পাওয়া যায়নি বলে কোনও মামলা রুজু হয়নি। নম্বর ও লালবাতি-সহ গাড়ির রঙিন ছবি তুলে অভিযোগ জমা পড়লেই তারা তদন্তে নামবে।
কিন্তু পুলিশ তো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে লালবাতি লাগানো গাড়ি ধরে তল্লাশি চালাতে পারত! এ প্রসঙ্গে কলকাতা পুলিশের ডিসি (ট্রাফিক) দিলীপ আদকের বক্তব্য, “লালবাতি লাগানো গাড়ি যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁরা বিচার বিভাগ বা পুলিশ-প্রশাসনের উচ্চ পদাধিকারী অথবা কোনও কমিশনের প্রধান বা মন্ত্রী। বেআইনি ব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করতে গেলে প্রকৃত ব্যবহারকারীদের হেনস্থা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে পুলিশকে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে। তাই নির্দিষ্ট অভিযোগ না পেলে আমাদের করার কিছু নেই।”সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে অবশ্য কড়া হাতে লালবাতির অপব্যবহার ঠেকানো হবে বলেই দাবি করছেন প্রশাসনিক কর্তারা। যদিও আদালতের নির্দেশ হাতে পাওয়ার আগে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করতে তাঁরা নারাজ। এ দিন দিল্লিতে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমি রেলমন্ত্রী হিসেবেও কোনও দিন লালবাতি ব্যবহার করিনি। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও করি না। কারণ, এতে সাধারণ মানুষের অসুবিধা হয়। তবে লালবাতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কী রায় দিয়েছে তা ভাল ভাবে জানার পরেই বিস্তারিত কিছু বলা সম্ভব।” মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রও বলেছেন, “আগে রায় খতিয়ে দেখি। তার পরেই মন্তব্য করব।”
তবে মোটের উপর রাজ্য প্রশাসন মনে করছে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সঙ্গে রাজ্যের মনোভাবের পার্থক্য নেই। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের বক্তব্য, “এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় বিজ্ঞপ্তি যা রয়েছে আর শীর্ষ আদালত যা বলেছে, তার মধ্যে বিরোধ নেই। কেন্দ্রের নির্দেশিকা পশ্চিমবঙ্গ মেনে চলার চেষ্টা করে।”
কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা এর উল্টো বলেই দাবি করছেন পুলিশ মহলের একাংশ। তাঁরা বলছেন, এপ্রিলে পশ্চিমবঙ্গ পরিকাঠামো উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের ১২০ কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগে লালবাজারের গোয়েন্দারা ইন্দ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেন। ওই ব্যক্তি পাঁচ বছর আগেও ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। এ বার তাঁকে গ্রেফতার করার পর জানা যায়, ইন্দ্রজিৎ এক বছর ধরে অবাধে গাড়িতে লালবাতি ব্যবহার করছিলেন। ট্রাফিক পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নিলে ইন্দ্রজিতের মতো ব্যক্তিরা যে পার পেতেন না, তা স্বীকার করে নিচ্ছেন গোয়েন্দারা।
বস্তুত, বারাসতে তিন দুষ্কৃতী লালবাতি লাগানো গাড়ি নিয়ে একের পর এক অপরাধ করে বেড়াচ্ছে, এমন ঘটনা সামনে আসার পরেই পুলিশকে কড়া হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। আগে বেআইনি ভাবে গাড়িতে লালবাতি ব্যবহারের জন্য মোটরযান আইনের ১০৮ নম্বর ধারা অনুসারে ১০০ টাকা জরিমানা দিয়েই অভিযুক্ত রেহাই পেয়ে যেতেন। কিন্তু গত মে মাসে হাইকোর্ট এক নির্দেশে বলে, বেআইনি ভাবে গাড়িতে লালবাতি ব্যবহার করলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪১৯ নম্বর ধারায় জালিয়াতির উদ্দেশ্যে পরিচয় ভাঁড়ানোর অভিযোগে পুলিশকে মামলা রুজু করতে হবে। এটি জামিনযোগ্য অপরাধ, কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিন বছর পর্যন্ত হাজতবাস করতে হতে পারে। কিন্তু সেই নির্দেশ দেওয়ার পরে একটিও মামলা দায়ের হয়নি।
হাইকোর্টের নির্দেশের আগে অবশ্য ৪১৯ ধারায় দু’টি মামলা দায়ের করেছিল কলকাতা পুলিশ। গত বছর নভেম্বরে রাজ্য সরকারের প্রধান সচিব পদমর্যাদার এক অফিসারের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়। ওই আমলা লালবাতি ব্যবহারের অধিকারী হলেও ফ্ল্যাশার-সহ লালবাতি ব্যবহারের অধিকারী ছিলেন না। আবার গত বছর মে মাসে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ কর্তা বেআইনি ভাবে লালবাতি ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ জানান হাইকোর্টের কয়েক জন আইনজীবী। তাঁর বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়। দু’টি মামলাই বিচারাধীন। অভিযুক্তেরা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই জামিন পেয়ে গিয়েছিলেন।
অভিযোগ না-পেলে তাদের কিছু করার নেই পুলিশের এই যুক্তি খারিজ করে আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, প্রয়োজনে পুলিশকে লালবাতি লাগানো প্রতিটি গাড়ি থামিয়ে দেখতে হবে, যিনি ওই গাড়ি ব্যবহার করছেন, তিনি সত্যিকারের অধিকারী কি না। আসলে পুলিশের সদিচ্ছারই অভাব রয়েছে।” লালবাতি ব্যবহার নিয়ে মামলায় জয়ন্তবাবুকে আদালত-বান্ধব নিয়োগ করেছিল হাইকোর্ট। পুলিশের মনোভাবের কথা আদালতের কাছে তুলে ধরবেন বলে জানিয়েছেন জয়ন্তবাবু।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে রাজ্য সরকারি আধিকারিকদের মনোভাবে অবশ্য খানিকটা হলেও বদল দেখা দিয়েছে। বুধবার খবরের কাগজে নির্দেশের কথা পড়েই লালবাতি খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মুর্শিদাবাদের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অজয় চক্রবর্তী এবং মালদহের এডিএম (জেলা পরিষদ) অমলকান্তি রায়। অমলবাবুর কথায়, “গাড়িতে লালবাতি লাগানোই ছিল। দায়িত্ব নেওয়ার পরে ওটা খোলার কথা ভাবলেও হয়ে ওঠেনি।”
মুখ্যমন্ত্রীর পথ অনুসরণ করে তৃণমূলের মন্ত্রীদের অনেকে গাড়িতে এমনিতেই লালবাতি লাগান না। কেউ কেউ জেলায় থাকাকালীন লালবাতি ব্যবহার করলেও কলকাতায় করেন না। এ বার সর্বত্রই লালবাতি ছাড়ার কথা ভাবছেন তাঁরা। মুর্শিদাবাদের মন্ত্রী সুব্রত সাহা যেমন বলছেন, “হাঁফ ছেড়ে বাঁচব। মাথার উপরে লালবাতি জ্বলতে দেখে অস্বস্তি হয়।”
লালবাতির নির্দেশ নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই মুর্শিদাবাদেরই কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীর। রেল প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ফ্ল্যাশার ছাড়া লালবাতি পাওয়ার অধিকারী হলেও মুর্শিদাবাদে সরকারি গাড়ি পর্যন্ত ব্যবহার করেন না তিনি। কেন? অধীরের সহাস্য মন্তব্য, “চেনা বামুনের পৈতে লাগে না!”


রাজ্যে যাঁদের লালবাতি
ফ্ল্যাশার-সহ
• রাজ্যপাল
• প্রাক্তন রাজ্যপাল
• মুখ্যমন্ত্রী
• প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী
• হাইকোর্টের বিচারপতি
• বিধানসভার স্পিকার
• বিরোধী দলনেতা
• পূর্ণ মন্ত্রী
ফ্ল্যাশার ছাড়া
• নির্বাচন কমিশনার
• ডেপুটি স্পিকার
• প্রতিমন্ত্রী
• অ্যাডভোকেট জেনারেল
• মুখ্যসচিব
• প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান
• সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান
• তফসিলি জাতি-উপজাতি কমিশনের চেয়ারম্যান
• পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান
বাতি-হারা
লালবাতির গাড়ি অলঙ্কার
ছাড়া কিছু নয়। না
থাকলে ক্ষতি নেই।
মালবিকা সরকার
লালবাতিকে স্টেটাস সিম্বল
হিসেবে দেখিনি। শুধু
অফিসের কাজেই লালবাতি
ব্যবহার করি।
সুরঞ্জন দাস
সরকারের থেকে কোনও
নির্দেশ পাইনি। নিয়ম
যা হবে, মেনে চলব।
শোভন চট্টোপাধ্যায়
রায় হাতে পেলে প্রতিক্রিয়া জানাব।
বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে চলব।
আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.