|
|
|
|
উচ্চপদে ছাড় তবে তালিকা যেন না বাড়ে |
যথেচ্ছ লালবাতিকে লাল সঙ্কেত শীর্ষ আদালতের |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
গাড়িতে লালবাতি লাগিয়ে ক্ষমতা জাহির করার চেষ্টা দেশের সংবিধান ও প্রজাতন্ত্রের মূল নীতির বিরোধী বলে রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি জি সিঙ্ঘভি এবং বিচারপতি সি নাগাপ্পন বলেছেন, ভারতে জনপ্রতিনিধি আর বিভিন্ন স্তরের আধিকারিকরা লালবাতি ও হুটারের যে যথেচ্ছ অপব্যবহার করেন, অন্য কোনও গণতান্ত্রিক দেশে তার নজির নেই।
মঙ্গলবার একটি জনস্বার্থ মামলার নিরিখে শীর্ষ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ, এখন থেকে উচ্চ পদাধিকারীরা শুধু কর্তব্যরত অবস্থাতেই লালবাতি ব্যবহার করতে পারবেন। এই পদাধিকারীদের তালিকা ইচ্ছে মতো বাড়াতে পারবে না কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার। লালবাতি ও হুটারের অপব্যবহার বন্ধ করতে মোটরযান আইন সংশোধন করে শাস্তির মাত্রাও বাড়াতে বলা হয়েছে কেন্দ্রকে।
এই মুহূর্তে কোন কোন পদাধিকারী সরকারি গাড়িতে লালবাতি ব্যবহার করছেন, কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিকে তিন মাসের মধ্যে তার তালিকা জমা দিতে হবে সুপ্রিম কোর্টে। সেই সঙ্গে এ দিনের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে লালবাতি যারা ব্যবহার করতে পারবেন, সেই উচ্চ পদাধিকারীদের নতুন তালিকাও প্রকাশ করতে হবে তিন মাসের মধ্যে।
উচ্চ পদাধিকারী বলতে কাদের বোঝানো হচ্ছে? শীর্ষ আদালতের বেঞ্চ বলেছে, সাংবিধানিক পদমর্যাদাভুক্তরাই এর আওতায় পড়ছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের ২০০২ এবং ২০০৫-এর বিজ্ঞপ্তিতে যে পদ-তালিকা দেওয়া আছে, লালবাতির ব্যবহারে তার বাইরে যাওয়া যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে বেঞ্চ। রাজ্য সরকারগুলিও কেবল সমগোত্রীয় পদগুলির ক্ষেত্রেই লালবাতি ব্যবহার করতে দিতে পারবে।
কেন্দ্রীয় বিজ্ঞপ্তি (সংশোধিত ২০০৫) অনুযায়ী ফ্ল্যাশার-সহ (গাড়ির উপরে ঘুরন্ত বাতি) লালবাতি লাগাতে পারবেন বর্তমান ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, বর্তমান ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, লোকসভা ও রাজ্যসভার স্পিকার ও চেয়ারম্যান, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান, সংসদের দুই কক্ষের বিরোধী দলনেতা এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা।
ফ্ল্যাশার ছাড়া লালবাতি ব্যবহারের অধিকারীরা হলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার, কনট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান, লোকসভার ডেপুটি স্পিকার, কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী, যোজনা কমিশনের সদস্য, অ্যাটর্নি জেনারেল, ক্যাবিনেট সচিব, প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিন প্রধান, জেনারেল ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদার সেনা অফিসার, কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান, সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান, তফসিলি জাতি ও উপজাতি কমিশনের চেয়ারম্যান, এবং ইউপিএসসি-র চেয়ারম্যান।
সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, এই পদাধিকারীরাও শুধু মাত্র কর্তব্যরত অবস্থাতেই লালবাতি ব্যবহার করবেন, তবে হুটার বাজাবেন না। হুটার বা সাইরেন ব্যবহারের অধিকার শুধু মাত্র অ্যাম্বুল্যান্স এবং দমকলের মতো জরুরি পরিষেবার গাড়ির জন্যই সীমিত রাখতে হবে। জরুরি পরিষেবার গাড়ি, পাইলট কার, উচ্চ পদাধিকারীদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কনভয়ের গাড়ি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে যাওয়া পুলিশের গাড়ির ক্ষেত্রে সাদা, নীল বা একাধিক রঙের বাতি লাগানো চলবে। কিন্তু লালবাতি নৈব নৈব চ।
যথেচ্ছ লালবাতি লাগানো এবং হুটার বাজানোর বিরুদ্ধে এই জনস্বার্থ মামলাটি দায়ের করেন উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা অভয় সিংহ। তিনি তাঁর আবেদনে বলেছিলেন, পুলিশ ও প্রশাসন লালবাতি আর হুটারওয়ালা গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো ভিআইপিদের নিরাপত্তা দিতেই ব্যস্ত। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার দিকে তাদের নজর নেই। সেই জন্যই নির্ভয়াদের মরতে হচ্ছে। আদালত বান্ধব হরিশ সালভে-ও এ দিন শীর্ষ আদালতে বলেন, ভিআইপি-রা গাড়িতে লালবাতি লাগিয়ে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ান। তার জেরে যানজট হয়। সাধারণ মানুষকে ভুগতে হয়। আদালত এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছে।
বিচারপতি সিঙ্ঘভির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এ দিন বলেছে, লালবাতি লাগানোটা ইদানীং স্টেটাস সিম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে করে ব্রিটিশ রাজের মানসিকতাই বয়ে নিয়ে চলা হচ্ছে। লালবাতির গাড়ি প্রায়শই ক্ষমতা জাহির করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে এবং লালবাতির আড়ালে অপরাধমূলক কাজকর্ম বেড়ে চলেছে।
কেন্দ্রের তরফে অবশ্য সলিসিটর জেনারেল এবং অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল আদালতে সওয়াল করেন, লালবাতি একেবারে বাদ দেওয়া ঠিক নয়। জনপ্রতিনিধি ও উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের কাজের স্বার্থেই তাঁদের যাতায়াত সুগম করা দরকার। সর্বোচ্চ আদালত সব দিক খতিয়ে দেখে শুধু মাত্র সাংবিধানিক পদাধিকারীদের জন্যই লালবাতি ব্যবহারের অনুমতি বজায় রেখেছে। রাজ্যগুলি যে ভাবে নানা সময়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে তাদের ইচ্ছে মতো লালবাতি-প্রাপকদের তালিকা বাড়িয়ে নেয়, তা বন্ধ হওয়া দরকার বলে বিচারপতিদের নির্দেশ। সেই কারণেই নতুন তালিকা প্রকাশ এবং চলতি তালিকা আদালতে জমা দিতে বলেছেন তাঁরা। বিচিত্র শব্দের হর্ন বাজানোর প্রবণতা বন্ধ করতেও কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিকে এক মাসের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে কারা কারা লালবাতি ব্যবহার করতে পারবেন, কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে রাজ্য পরিবহণ দফতর তার তালিকা প্রকাশ করে থাকে। সেই তালিকায় নামের সংখ্যাও বাড়ে। গত বছর তালিকায় রাজ্যের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতির নাম ঢুকেছে। যুক্ত হয়েছে ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যানের নামও। ২০০৯ সালে তালিকায় ঢোকানো হয় জেলা জজ, কলকাতা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, সিটি সিভিল কোর্টের মুখ্য বিচারক, সিটি সেশনস কোর্টের মুখ্য বিচারক এবং কলকাতা পুরসভার কমিশনারের নাম। রাজ্য পরিবহণ দফতরের তথ্য বলছে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ২০১২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত রাজ্যে চার বার লালবাতি লাগানো গাড়ির তালিকায় সংযোজন হয়েছে।
এর পাশাপাশি লালবাজারের কর্তারা স্বীকার করছেন, তালিকার বাইরেও লালবাতি লাগানোর প্রবণতা এ রাজ্যে কম নয়। লালবাতির যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করতে গত ১৭ মে কলকাতা হাইকোর্ট পুলিশের হাতে বিশেষ ফৌজদারি ক্ষমতা অর্পণ করে। ওই ক্ষমতাবলে লালবাতির অবৈধ ব্যবহার দেখলে প্রতারণা ও পরিচয় ভাঁড়ানোর অভিযোগ এনে মামলা
করা যাবে। তৎসত্ত্বেও পুলিশ তেমন কোনও অভিযান করেনি গত ছয় মাসে। কিন্তু এ বার খোদ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে পুলিশ সক্রিয় হবে বলে মনে করা হচ্ছে। পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “অনেকেই যে বেআইনি ভাবে লালবাতি ব্যবহার করছেন, তা আমাদের নজরে এসেছে। আমরা সেই মতো ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছি।” কিন্তু রাজ্য সরকার নিজেই তো লালবাতির তালিকা ক্রমশ বাড়াচ্ছে! মদন বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ এলে, আমরা আমাদের ভুলত্রুটি থাকলে অবশ্যই শুধরে নেব।”
|
|
• লালবাতি এখন ‘স্টেটাস সিম্বল’ মাত্র। ব্রিটিশ রাজের মানসিকতা রয়ে গিয়েছে। |
• বিচারপতি জি এস সিঙ্ঘভি এবং বিচারপতি সি নাগাপ্পন। |
|
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ |
• সাংবিধানিক পদাধিকারীদের গাড়িতে লালবাতি
• অ্যাম্বুল্যান্স, পুলিশের গাড়িতে নীল বাতি
• রাজ্য খুশি মতো লালবাতির তালিকা বাড়াবে না
• এখন কারা লালবাতি পান, তালিকা জমা তিন মাসে |
|
|
কে কী বলছেন |
রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী ছাড়া
কারও
লালবাতি নেওয়া উচিত নয়।
জয়রাম রমেশ,
কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী |
আমার সরকারি গাড়ি থেকে এ
বার লালবাতি খুলে দিতে বলব।
ওমর আবদুল্লা, জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী |
মুখ্যমন্ত্রী গাড়িতে লালবাতি লাগান
না, আমিও তো ছেড়ে দিয়েছি।
মদন মিত্র,
পশ্চিমবঙ্গের পরিবহণমন্ত্রী |
|
|
|
|
|
|
|