ওঁরা হেঁশেল সামাল দেন, চুল বাঁধেন। আবার গ্রামের পর গ্রাম উজিয়ে হাঁস-মুরগির চিকিৎসাও করেন। গত সাড়ে তিন বছর ধরে বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত গাঁ-গঞ্জ ঘুরে সরকারি নির্দেশের দায় সামলে ওঁদের প্রাপ্তি অবশ্য নিছক একটা সরকারি তকমা, ‘প্রাণিমিত্রা’।
হাস-মুরগির রোগ মুক্তি প্রতিষেধক আর কখনও বা গরু-বাছুরের জরুরি টিকা দিয়ে গ্রামীণ এই সব ‘টিকা-দিদি’দের রুজির প্রশ্নটা অবশ্য এখনও ঝুলে রয়েছে নিছকই ‘দয়া-দাক্ষিণ্যে’র উপরে। হ্যাঁ, বাহারি ওই সরকারি তকমা ছাড়া প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের ওই মহিলা কর্মীদের এখনও কোনও নির্দিষ্ট আয় নেই। তাই প্রাণিমিত্রাদের টিকারণ কর্মসূচি একশো দিনের কাজের আওতাভূক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। বছর ঘুরছে, সাড়া দেয়নি রাজ্য সরকার।
কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের অধীনেই প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন শাখা। গত জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শারদ পওয়ার বিভিন্ন রাজ্যের প্রাণিসম্পদ দফতরের মন্ত্রী ও সচিবদের দিল্লিতে বৈঠকে ডেকেছিলেন। সেখানেই তাঁর প্রস্তাব ছিল, জাতীয় কর্মসুনিশ্চিত প্রকল্প এবং রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনায় কাজে লাগানো হোক প্রাণিবন্ধু ও প্রাণিমিত্রাদের। কৃষি মন্ত্রকের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “প্রাণিমিত্রা এবং প্রাণিবন্ধুদের আয়ের উপায় খুঁজতে রাজ্যগুলিকে ওই প্রস্তাব দেওয়া হলেও, পশ্চিমবঙ্গ-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্য এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি।” কেন সাড়া দেয়নি রাজ্য সরকার? প্রাণিবিকাশ মন্ত্রী নুরে আলম চৌধুরী কোনও মন্তব্যই করতে চাননি। তবে ওই দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “ওই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়নি।” |
মাধ্যমিক পাশ করা গ্রামীণ মহিলাদের কর্মসংস্থানের উপায় বাতলাতে ২০১০ সালে প্রাণিমিত্রা পদের উদ্ভব। রাজ্যের বেশ কয়েকটি জেলায় দিন পনেরোর প্রশিক্ষণ দিয়ে কয়েকশো মহিলাকে হাতে কলমে শেখানো হয়, হাঁস-মুরগি এবং গরু ও ছাগলের বিভিন্ন টিকাকরণের পদ্ধতি। তাদের রোগ চেনার উপায়। রাজ্য জুড়ে অন্তত পাঁচশো মহিলা এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ নিলেও হুগলি জেলা এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। মাসখানেকর মধ্যেই বিভিন্ন ব্লকে কাজও শুরু করেছিলেন প্রাণিমিত্রা’রা।
প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে হুগলির হরিপাল ব্লকের প্রাণিমিত্রারাই এ ব্যাপারে এগিয়ে ছিলেন। ওই দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “সামান্য রোজগার, তবু উৎসাহ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন ওরা। কিন্তু নির্দিষ্ট আয় না থাকলে উৎসাহে ভাঁটা পড়তে কতক্ষণ। ক্রমে সরে যেতে থাকলেন ওই মহিলারা।”
সাকুল্যে একটা কিট, তাতে খান কতক সিরিঞ্জ, পাঁচ ধরনের টিকা আর একটা ‘কুল বক্স’ দিয়ে গ্রামে হাঁস-মুরগির রোগ বালাই রোখার দায়িত্ব সামাল দিয়ে চলেছেন প্রাণিমিত্রারা। সরকারি কুল বক্স বিকল হওয়ায় অনেকে নিজের খরচে বাড়িতে ফ্রিজ কিনেছিলেন। কিন্তু রোজগার কই?
প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের এক শীর্ষ কর্তার আক্ষেপ, “প্রাণিমিত্রাদের জন্য যে সরকারি রেট বেঁধে দেওয়া হয়েছে তা বলতেও অস্বস্তি হয়।” কী সেই ‘রেট’--হাঁস-মুরগির রানিখেত প্রতিষেধক এফ-১, আর-২বি, গামবোরা রোগের প্রতিষেধক টিকা প্রতি ২৫ পয়সা। ছাগলের গোট-পক্স কিংবা পিপিআর টিকা প্রতি তাঁদের প্রাপ্য এক টাকা। আর গরু-বাছুরের ফুট অ্যান্ড মাউথ কিংবা বজবজে রোগের টিকা দিলে ৫ টাকা। গ্রামের পোলট্রিগুলিতে একসঙ্গে অনেক মুরগির টিকা দিলে তা কমে দাঁড়ায় টিকা প্রতি ১০-২০ পয়সা। এই ‘বাঁধা বরাদ্দ’ও অবশ্য সব সময় জোটে না।
ধনেখালির তহমিনা বেগম কিংবা হরিপালের প্রতিমা মান্নারা বলেন, “গ্রামের গরিবগুর্বো মানুষ অনেক সময়েই পয়সা দিতে পারেন না। গরু-ছাগলের টিকা দিলে অনেক সময়েই শুনতে হয়, ‘মাসের শেষ হাতে পাঁচটা টাকাও নেই। তবু তাঁরা দয়া করে যেটুকু দেন আমাদের আয় বলতে সেটুকুই।” প্রত্যন্ত ওই সব গ্রামে ওই সামান্য প্রাপ্য আদায়ের জন্য দ্বিতীয়বার পাড়ি দেওয়াও পোষায় না তাঁদের। তহমিনা বলেন, “দূরের গ্রাম, প্রাপ্য আদায়ের জন্য যাতায়াতেও যা খরচ পড়ে পাওনা হয়তো তার চেয়েও কম, গিয়ে আর কী হবে!”
পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন বছরে মুরগির রানিখেত, হাঁসের গামবোরা এমনকী গরুর ফুট অ্যান্ড মাউথ রোগ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে। তার একটা বড় কারণ যে প্রাণিমিত্রাদের টিকারণ কর্মসূচি প্রাণিসম্পদ দফতরের কর্তারা তা মেনে নিয়েছেন। এক কর্তা বলেন, “বছর কয়েক আগেও রানিখেত বা গামবোরার মতো মড়কে রাজ্য জুড়ে হাঁস-মুরগি মারা যেত। গত তিন বছরে প্রাণিমিত্রারা গ্রামে ঘুরে প্রাথমিক প্রতিষেধকটা সময়মতো দিয়ে সেটা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন।” চার-আনার প্রাপ্তি যোগে আর কতদিন সেই মড়ক রুখবেন তাঁরা, প্রশ্ন সেটাই। |