দুয়ারে সসঙ্কোচে থমকে আছে শীত।
তবে ভরসার কথা, যে ডানায় ভর করে উত্তুরে হাওয়া এসে আছড়ে পড়ে গাঙ-বাংলায়, ইতিউতি তার দেখা মিলতে শুরু করেছে। শহরতলি আর মফস্সলের ঘাটে-বাটে চোখে পড়তে শুরু করেছে তাকে। শীর্ণ পায়ে মাঠ ভেঙে তুর তুর করে এগিয়ে চলেছে সে। দ্রুত চলনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নেচে চলেছে তার পুচ্ছটি। সেই পুচ্ছ ছুঁয়েই হারানো সেই শীত এ বার শহরেও এল বলে।
খঞ্জনা এসে গিয়েছে।
তার দেখা মিলতেই বয়োবৃদ্ধরা বলতে শুরু করেছেন, ‘কই গো দেখো, ওরা এসে গিয়েছে। লেপ, আলোয়ানগুলো রোদে দাও এ বার।’
কবেকার পাড়াগেঁয়ে সেই প্রবাদটা গ্রাম-গঞ্জে এখনও দিব্যি তরতাজা, ‘খঞ্জনার নাচন, শীতের কাঁপন’। শহরেও তাকে নিয়ে হারানো স্মৃতির ভিড়। ইঞ্চি সাতেকের পাখিটার পুচ্ছ-নাচন বলিরেখা দীর্ণ কলকাতার পুরনো বাসিন্দাদেরও ফেলে আসা শীতকালের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। তবে, এ শহরে এ বার যেন একটু দেরিতেই দেখা মিলছে তাদের। সুদূর উরাল পর্বত কিংবা কাজাখস্থানের উপত্যকা থেকে জুলাই অন্তে পাড়ি দিয়ে এ দেশে আসতে সময় তো লাগবেই! |
সেপ্টেম্বরের শেষ থেকেই পূর্ব ভারতের মাঠ-ঘাট, পোড়ো জমি কিংবা বর্ষা শেষে ক্রমে শুকিয়ে আসা নদী-নালা-জলার আনাচে কানাচে তাদের তীব্র চলন আর অনর্গল পুচ্ছ নাচন নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে হাজির হয় ‘ওয়্যাগটেল’ বা খঞ্জনা। উত্তরবঙ্গের গ্রাম-শহরে বর্ষা শেষেই তাদের দর্শন পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু কলকাতা বা লাগোয়া শহরতলিতে যেন ক’দিন দেরি হয়ে গেল তাদের আসতে।
শীত কি সে জন্যই খানিক থমকে রয়েছে? বিশিষ্ট পক্ষিবিদ সুমিত সেন অবশ্য বলেন, “প্রবাদ আর কড়া বাস্তবের মধ্যে একটা দূরত্ব থাকেই। তাই খঞ্জনার ডানায় ভর করেই শীত আসে, এটা ভাবতে ভাল লাগলেও ব্যাপারটা তার উল্টোও হতে পারে। যদিও পরিযায়ী পাখিদের এই মরসুমি আনাগোনা নিয়ে বিস্তর গবেষণার পরেও এখনও কোনও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায়নি।” বোম্বে ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটির হয়ে পাখিদের পরিভ্রমণ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করার অভিজ্ঞতা থেকে এম এস শশিকলা বলছেন, ‘‘শীতের বার্তা পরিযায়ীরা আগাম পায় কি না তা নিশ্চিত ভাবে হ্যাঁ বা না বলা সম্ভব নয়। তবে, প্রবল ঠান্ডা বা প্রবল দাবদাহ এড়াতে দেশ থেকে দেশান্তরে তাদের উড়ে যাওয়ার একটা আগাম তাগিদ যে তারা অনুভব করে এটা স্পষ্ট।” গবেষণার সে ভারী কথা বাদ দিলে বাংলার প্রবাদ ও লোককথায় শীত এবং খঞ্জনা প্রায় সমার্থক।
যেমন চাতকের (জ্যাকোবিন কাক্কু) সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে রয়েছে বর্ষাকাল। গ্রীষ্ম শেষে আকাশ কালো করে অজস্র চাতকের ওড়াউড়ি যেন বলে দেয়, বর্ষা আসছে। দক্ষিণবঙ্গের চেনা লোকগাথায় বলছে, ‘চাতক ভাসে/ বর্ষা আসে’। চাতকের ডানা ঝাপটানো চোখে পড়লেই গাঙ্গেয় বঙ্গের মানুষ তাই চোখ তুলে চান আকাশে, বর্ষা এল নাকি! বিশিষ্ট লোকবিদ্যার গবেষক মৃগাঙ্ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “বাদাবন থেকে রাঢ় বাংলা, গ্রামের মানুষ আজও বিশ্বাস করেন, চাতকের ডানায় বর্ষা আসে। আষাঢ়ের আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে চাতকের আগমন
ঘটে। তাই বর্ষার অনুষঙ্গে চাতক পাখিদের নিয়ে বহু লোকগাথা প্রচলিত রয়েছে।”
শুধু এ দেশে কেন, সুদূর মার্কিন মুলুকেও প্রজাপতির ডানায় ঋতু বদলের নানা গল্প রয়েছে। মার্কিন মুলুকের মোনার্ক প্রজাপতি মরসুমের বার্তাবাহী পতঙ্গ। উত্তর আমেরিকার মন্টানা, মিনেসোটা, নেব্রাস্কার মানুষ মনে করেন তাদের কমলা-কালো রংবাহারি ডানায় গ্রীষ্ম মুছে দিয়ে মোনার্ক প্রজাপতিরা উড়ে যায় ক্যালিফোর্নিয়া সমুদ্র উপকূল হয়ে মেক্সিকো, কিউবার দিকে। উত্তর আমেরিকার বনে-বাগানে মোনার্ক প্রজাপতি হারিয়ে যেতে শুরু করলেই শীতের বার্তা পেয়ে যান মানুষ। অন্টারিও প্রদেশের রূপকথার গল্পে রয়েছে, ‘অ্যাবসেন্স অফ মোনার্ক শোজ দ্য প্রেসেন্স অফ উইন্টার।’
প্রবল শীতের সেই জবুথবু প্রান্তর থেকে ঠান্ডা এড়াতেই মোনার্ক প্রজাপতির মতোই খঞ্জনার ঝাঁকও ঈষৎ উষ্ণতার খোঁজে উড়ে আসে এ দেশে। বৎসরান্তে এ দেশে অবশ্য তখন শীতের ছোঁয়া লেগেছে। তবে তা উরাল পর্বতের পাদদেশ বা কাজাখস্থানের কঠোর ঠান্ডার মতো তো নয়। পক্ষীপ্রেমী স্বপন শূর জানান, এ দেশে মূলত পাঁচ ধরনের ওয়্যাগটেল বা খঞ্জনার দেখা মেলে। তার মধ্যে ‘ফরেস্ট ওয়্যাগটেল’ বছরভরই দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে উড়ে বেড়ায়। তবে হোয়াইট ওয়্যাগটেল (উড়ে আসে উরাল পর্বতমালা থেকে), পাইড ওয়্যাগটেল (ক্যাসপিয়ান উপসাগরীয় এলাকা), আমুর ওয়্যাগটেল (চিন, কোরিয়া), ব্ল্যাক হেডেড ওয়্যাগটেল (কামচাটকা ও কাজাখস্থান) বাস্তবিকই পরিযায়ী। পাহাড়-সমুদ্র উজিয়ে তাদের কেউ বা এ দেশে মাটি ছোঁয় অগস্টের শেষ সপ্তাহে কেউ বা আরও পরে অক্টোবর, নভেম্বর প্রান্তে।
পশ্চিমবঙ্গ-অসমের মাঠ-ঘাটে হোয়াইট ওয়াগটেল বা খঞ্জনার আগমন ঘটে শেষ শরতে। অসমের পক্ষিবিদ গৌতম শইকিয়া বলেন, “ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মানুষ এখনও বিশ্বাস করেন, খঞ্জনার ঝাঁক এসে পড়ল মানে বানভাসি-আশঙ্কার দিন শেষ হল। শীত আসছে, নদী এ বার শান্ত হয়ে পড়বে।” আর আমরা?
ময়দান ভরে উঠছে কুয়াশায়, দ্রুত পড়ে আসছে বেলা, মাঠময় খঞ্জনার উচ্ছল হুটোপুটি, আমরা কি এ বার শীতের দুয়ারে পৌঁছব! |