এ তাদের পথ। আমাদেরও। তাদের পায়ে চলা পথ ফুঁড়ে তাই নিত্য ছোটে লৌহযান। একের পর এক তারা ছিটকে পড়ে লোহার সরীসৃপের ছোবলে। এটা যে সভ্যতার পথ নয়, প্রকৃতিপ্রেমীরা তা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন। মন্ত্রী বা মন্ত্রক, দফতর বা আমলা তেমন কোনও বিরোধিতা আসেনি কোনও মহল থেকেই। কিন্তু পরিস্থিতিও বদলায়নি। অনেক বৈঠক, আলোচনা, প্রতিশ্রিতি ও ঘোষণার পরেও ট্রেনের ধাক্কায় হাতির মৃত্যু বা জখম হওয়ার ঘটনা বন্ধ হয়নি উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে। শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এল দেশের শীর্ষ আদালত।
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ার জংশন, প্রায় ১৬৮ কিলোমিটার রেলপথে রাতে ট্রেন চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করল সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। দুই সদস্যের এই বেঞ্চ মঙ্গলবার এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তী রায় দেওয়ার পাশাপাশি সতর্ক করে দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষকে।
বেশ কিছু দিন ধরেই বন দফতর ওই রেলপথে ট্রেনের সংখ্যা ও গতি নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়ে আসছিল। রেল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করলেও তা কার্যকর করায় কোনও রকম তৎপরতাই দেখায়নি বলে বন দফতরের অভিযোগ। শীর্ষ আদালত ওই রেলপথে রাতে মালগাড়ি চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। সেই সঙ্গে রাতের যাত্রিবাহী ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট এ দিন রাজ্য সরকারের বক্তব্য জানতে চাইলে রাজ্য সরকারের আইনজীবী স্পষ্টই জানান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মালগাড়ির নিয়ন্ত্রণহীন গতি হাতিদের লাইন পারাপারের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দুর্ঘটনা ঘটছে তার ফলেই। তাই ওই পথে অন্তত রাতে মালগাড়ি চলাচল বন্ধ করা হোক, এমনই দাবি করেছিল বন দফতর। সেই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা হোক রাতের দূরপাল্লার ট্রেনের গতি। পরে রাজ্য সরকারের আইনজীবী অভিজিৎ ভট্টাচার্য বলেন, “রাজ্য সরকারের আবেদনে সাড়া দিয়ে আগামী ২১ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য করেছে শীর্ষ আদালত। তবে তার আগে, ওই রেলপথে মালগাড়ি ও যাত্রিবাহী ট্রেন চলাচলে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।” |
বিস্তারিত দেখতে ক্লিক করুন... |
|
|
বন দফতর এবং উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পশুপ্রেমী সংগঠনের বিরোধিতা উপেক্ষা করে ২০০৪ সালে নিউজলপাইগুড়ি থেকে গুয়াহাটিগামী মিটারগেজ রেলপথটি ব্রডগেজে রূপান্তরিত করা হয়। ওই পথে ক্রমশ বাড়তে থাকে ট্রেন ও মালগাড়ির সংখ্যা। এখন ওই রেলপথে দিনেরাতে মোট আট জোড়া যাত্রিবাহী ট্রেন চলাচল করে। মালগাড়ি চলে ৬ থেকে ৯ জোড়া। গত ন-বছরে এই রেলপথে ট্রেনের বলি হয়েছে অন্তত ৫২টি হাতি। মৃত্যু হয়েছে বেশ কিছু বাইসন, হরিণ ও চিতাবাঘের। বছর কয়েক আগে ছুটন্ত ট্রেনের ধাক্কায় মারা গিয়েছে একটি বাঘও। দুর্ঘটনা এড়াতে বনকর্তারা একাধিক বার রেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসলেও সমস্যা অবশ্য মেটেনি। এ ব্যাপারে বন দফতরের দাবি ছিল, ওই রেলপথে দূরপাল্লার ট্রেনগুলির গতি বেঁধে দেওয়া হোক ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটারে। সেই সঙ্গে বন্ধ করা হোক মালগাড়ি চলাচল। বন দফতরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে স্থানীয় পশুপ্রেমী সংগঠনগুলি বেশ কিছু দিন ধরেই ওই দাবি জানিয়ে আসছিল। সম্প্রতি এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেন শক্তিপ্রসাদ নায়েক নামে এক ব্যক্তি।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশানুসারে, শুনানি না হওয়া পর্যন্ত, আপাতত ওই পথে মালগাড়ি চলাচল কি বন্ধ করে দেওয়া হবে? রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ হাতে না পাওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে, উত্তর পূর্ব-সীমান্ত রেলের ডিআরএম (আলিপুরদুয়ার ডিভিশন) বীরেন্দ্র কুমার বলেন, “রাজ্য সরকারের আবেদন মেনে ওই পথে রাতের ট্রেনে ইতিমধ্যেই গতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। তবে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ পেলে সেই মতো তা মেনে চলা হবে।” তবে, ওই রেলপথে যাত্রিবাহী ট্রেন চলাচলের উপরে এখনই দাঁড়ি টানতে চাইছে না রেল কর্তৃপক্ষ। রেলের এক পদস্থ কর্তা জানান, বহু দূরপাল্লার ট্রেন ওই পথে চলাচল করে। রাতারাতি সেগুলি অন্য পথে চালানো সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে ট্রেনের সময়ের হিসেব বদলে যাবে। বীরেন্দ্র কুমার মনে করেন, “যাত্রীদের অসুবিধার কথা মাথায় রেখেই সম্ভবত যাত্রিবাহী ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও তা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়নি শীর্ষ আদালত।”
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অবশ্য খুশির হাওয়া বন দফতরে। বন দফতরের হেড অব ফরেস্ট নবীনচন্দ্র বহুগুণা বলেন, “বন্যপ্রাণের সুরক্ষায় আমরা ঠিক কী চাই, তা শীর্ষ আদালতে জানানো হয়েছে। জনস্বার্থ মামলার অন্তর্বর্তী রায়ও যথেষ্ট আশাপ্রদ। এখন রেল তা মানে কিনা সেটাই দেখার।”
|