প্রবন্ধ ২...
শরৎ মৃত, হেমন্ত যায় যায়, অথ বসন্তবিদায়?
রতের দফারফা হয়েছিল আগেই। বছর কয়েক হল উধাও শরতের তুলোর মতো পেঁজা মেঘ, হিমের পরশ, শেষ আশ্বিনে শিউলির কাঁপন। শরৎ কালটাকে পুরোপুরি খেয়ে নিয়েছিল বর্ষা। এ বার হেমন্তেও সে থাবা বসিয়েছে। মেঘের দাপটে তার উত্তুরে হাওয়া দূর অস্ত্। শুধু শরৎ বা হেমন্তই নয়, যে ভাবে আবহাওয়ার ধরন দিনকে দিন বদলে যাচ্ছে তাতে বসন্তের অস্তিত্বও আর ক’বছর পরে থাকবে কি? বিশেষজ্ঞরা অনেকেই সন্দিহান। গত কয়েক বছরের পর্যবেক্ষণ বলছে, অনেক সময় শীতটা টানছে ফাল্গুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত, তার পরেই তাপমাত্রা চড়ে যাচ্ছে ৩৫ ডিগ্রির উপরে। দখিনা বাতাসে গরম ভাব। শীতের পরেই লাফ দিয়ে চলে আসছে গ্রীষ্ম। ঠিক যে ভাবে শরৎ-হেমম্তকে লাফ দিয়ে পেরিয়ে হাজির হচ্ছে শীতও।
ব্যাপারটা ঘটছে কী ভাবে? বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া একের পর এক নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের জেরে অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা আর পশ্চিমবঙ্গ, তিন রাজ্যের বায়ুমণ্ডল থেকে জলীয় বাষ্পের চাদর কিছুতেই সরছে না। বাদল মেঘ আকাশ ছেয়ে থাকায় পেঁজা তুলোর মতো শরতের মেঘ আর দেখা যাচ্ছে না। এক আবহাওয়াবিদের কথায়, “পেঁজা তুলোর মতো মেঘ নির্মাণের পরিস্থিতিই তো তৈরি হতে পারছে না, তার দেখা মিলবে কোথা থেকে?” আলিপুর আবহাওয়া দফতরের পরিংসখ্যান বলছে, জুন থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে কমপক্ষে ১৪টি নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে। চারটি ক্ষেত্রে তা ঘূর্ণিঝড়ের চেহারা পেয়েছে। ঘন ঘন এই নিম্নচাপের জেরেই পরিমণ্ডলে ঢুকেছে জলীয় বাষ্প। তৈরি হয়েছে মেঘ। জুন থেকে নভেম্বর এই ছ’মাসে ক’ দিন সূর্য পুরো সময়ের জন্য আকাশে ছিল তা হাতে গুনে বলে দেওয়া যায়। কেবল নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে টানা সাত দিন মেঘ ছিল না আকাশে। এইটুকু বাদ দিলে, ওই ছয় মাসে টানা সাত দিন আকাশ পরিষ্কার ছিল না কখনও। ডিসেম্বরের প্রথম নয় দিনের মধ্যে আট দিনই আকাশে মেঘ ছিল।
গত কয়েক বছর ধরে বর্ষা গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে ঢুকছে প্রায় দিনক্ষণ মেনেই (৮ জুন দক্ষিণবঙ্গে বর্ষা ঢোকার স্বাভাবিক সময়)। কিন্তু বিদায় নেওয়ার সময় (স্বাভাবিক সময় ৮ অক্টোবর) তা দিনক্ষণ মানছে না। বর্ষার বিদায় নিতে নিতে অক্টোবর প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। যেমন এ বছরই বর্ষা বিদায় নিয়েছে ২১ অক্টোবর। আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানাচ্ছে, এ বার ৮ অক্টোবর পর্যন্ত গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বর্ষা ছিল সক্রিয়। তার পরের এক সপ্তাহ ঘূর্ণিঝড় পিলিন-এর প্রভাবে বর্ষা অতি সক্রিয় হয়ে যাওয়ায় পুজোর মধ্যে ব্যাপক বৃষ্টি নেমেছিল। তার পরে বৃষ্টি কমলেও অক্টোবর মাসে টানা রৌদ্রোজ্জ্বল দিন দেখেনি কলকাতা। এমনকী, খাতায়-কলমে বর্ষা বিদায় নেওয়ার পরেও অন্ধ্র উপকূলে তৈরি হওয়া একটি নিম্নচাপের জেরে প্রবল বৃষ্টি হয়েছিল কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে। নভেম্বর মাসে পর পর দুটি ঘূর্ণিঝড় হেলেন এবং লহর-এর দাপটে বেশির ভাগ সময়েই পরিমণ্ডলে ঢুকেছে জলীয় বাষ্প। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নিম্নচাপ হবে-হবে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সপ্তাহটা শেষ হতে না হতেই বঙ্গোপসাগরে তৈরি হল নতুন একটি ঘূর্ণিঝড়। নাম তার মাদি। ঝড় হিসেবে বিশেষ সুবিধে করতে পারল না সে, কিন্তু তার জেরে হেমন্তকালের আরও খানিকটা চুরি হয়ে গেল!
তা হলে কি সব শেষ? না, বিশেষজ্ঞরা ভরসা দিচ্ছেন, এটা সাময়িক পরিবর্তন। অন্তত এখনই জবাব দেওয়ার সময় আসেনি, অন্তত ৪০-৫০ বছরের তথ্য হাতে নিয়ে এ ব্যাপারে কোনও নির্দিষ্ট মতামত দেওয়া সম্ভব বলে মন্তব্য করছেন আবহবিদেরা। তাঁদের হিসেবে, গত পঞ্চাশ বছরে অন্তত আরও এক বার বঙ্গোপসাগরে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে চার-চারটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছিল। ঠিক এ বারের মতোই। ইতিহাস ভরসা। তবে লক্ষণ ভাল নয়, সেটা অনস্বীকার্য।
আরও একটা ব্যাপার আছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের লক্ষণ যে শুধু আমাদের এই পূর্ব ভারতেই প্রতীয়মান তা কিন্তু নয়। গোটা দেশ, গোটা পৃথিবীর চিত্রটাই এই। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেন্ট চেঞ্জ (আই পি সি সি)-র পঞ্চম রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ১১ নভেম্বর। সেই রিপোর্টে আবহাওয়ার এই পরিবর্তনের জন্য সমুদ্রতলের তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকেই দায়ী করে বলা হয়েছে, ‘দিন-কে দিন ওই তাপমাত্রা আরও বাড়বে। ফলে বাড়বে আবহাওয়ার খামখেয়াল। বিভিন্ন দেশে বর্ষা দীর্ঘায়িত হবে। ভারতীয় উপমহাদেশে বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বাড়বে। ব্যাপক ভূমিক্ষয় হবে। বিপদে পড়বেন বহু মানুষ।’’
এখানে বলা দরকার, সমুদ্রের জলের তাপমাত্রার হ্রাসবৃদ্ধি এবং পারিপার্শ্বিক বায়ুর গতিবেগ, অভিমুখ, এগুলোই নিয়ন্ত্রণ করে নিম্নচাপ কখন তৈরি হবে। সমুদ্রের জলের উপরিভাগের তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস কিংবা তার বেশি থাকলে নিম্নচাপ তৈরির সম্ভাবনা বাড়ে। তাপমাত্রা যত বাড়ে সমুদ্রের জল তত বেশি করে বাষ্পীভূত হয়। বাষ্পীভবনের ফলে তৈরি হওয়া গরম জলীয় বাষ্প উঠে যায় উপরের দিকে। নীচের স্তরে যে শূন্যস্থান তৈরি হয় তা যেমন বাষ্পীভবনের হার বাড়িয়ে দেয়, তেমনই আশপাশের গরম বাতাসকে আকর্ষণ করে। সেই বাতাসও উঠতে থাকে উপরের দিকে। উপরে উঠে তা ঠান্ডা বাতাসের সংস্পর্শে আসে। তৈরি হয় মেঘপুঞ্জ। সেই উল্লম্ব মেঘ কতটা উঁচু হবে, তার কেন্দ্রস্থলে বায়ুপ্রবাহের তীব্রতা কত হবে, তা কোন দিকে কী ভাবে এগোবে, সে-সব নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক বায়ুপ্রবাহের উপরে। মেঘপুঞ্জের কেন্দ্রস্থলের বায়ুপ্রবাহের তীব্রতাই বলে দেয়, কোনটা নিম্নচাপ, কোনটা গভীর নিম্নচাপ, কোনটা ঘূর্ণিঝড় হবে।
কী ভাবে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়, তার পুরো রহস্য কিন্তু এখনও বিজ্ঞানীদের অজানা। কোন কোন বিষয়ের উপরে তার তীব্রতা এবং স্থায়িত্ব নির্ভর করে তার পুরোটা জানা সম্ভব হয়নি বিজ্ঞানীদের পক্ষে। তাই আবহাওয়ার পূর্বাভাসের জন্য নানা ধরনের জটিল গাণিতিক প্রক্রিয়ার (ম্যাথমেটিক্যাল মডেল) সাহায্য নেন তাঁরা। আর্ন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থার তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন দেশ নিজেদের তৈরি মডেল অনুযায়ী আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়। তবে সেই পূর্বাভাস যে সব সময়েই পুরোপুরি মেলে, তা নয়। দিল্লির মৌসম ভবনের এক আবহাওয়াবিদের কথায়, “আমরা যে দিন সব রহস্যের সমাধান করতে পারব, সে দিন আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস মিলে যাবে পুরোটাই।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.