ভোটদাতা কী চান? চান, আয় বাড়বে, কাজের সুযোগ তৈরি হবে, জিনিসপত্রের দাম কমবে, পণ্য এবং পরিষেবা সরবরাহের সুষ্ঠু ব্যবস্থা হবে, সরকারি কাজকর্ম দক্ষ ভাবে সম্পন্ন হবে, দুর্নীতি থাকবে না, আইনশৃঙ্খলা সুরক্ষিত থাকবে, এই সব। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, এই সমস্ত বিষয়েই দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের মনে বিপুল অভিযোগ জমে উঠেছে। জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার আট থেকে পাঁচ শতাংশে নেমে এসেছে, এটা নিছক একটা সংখ্যার ব্যাপার নয়। এর মানে হল, আগের চেয়ে কম কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। যাঁরা টাকাপয়সা খরচ করে লেখাপড়া শিখছেন বা ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন, তাঁদের কাছে এটা গভীর হতাশার কারণ। গ্রামে বহু ছেলেমেয়ে আজ আর চাষবাসে আগ্রহী নন, তাঁরা বাইরে কাজ করতে চান। সেই সুযোগটাই কমে গেছে। আবার, যাঁরা কাজে নিযুক্ত আছেন, আয়বৃদ্ধির হার কমলে তাঁদের মাইনেপত্র বাড়ে না। এ দিকে বাজার দর আগুন। সংসার চালানো তাঁদের পক্ষে দুষ্কর হয়ে ওঠে। পাঁচ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি মানে, মানুষ ঠিক মতো ই এম আই দিয়ে উঠতে পারবে না। অর্থনীতির গতিভঙ্গ হলে মানুষ এ ভাবেই সেটা নিজের অভিজ্ঞতায় টের পায়। স্বভাবতই সরকারের বিরুদ্ধে, যাঁরা সরকার চালাচ্ছেন তাঁদের বিরুদ্ধে ভোটদাতাদের ক্ষোভ জমে।
ভারতের শহরে ও আধা-শহরে যে বিক্ষোভ আন্দোলন দেখা যাচ্ছে, তা হয়তো দুর্নীতি বা মেয়েদের যৌন লাঞ্ছনার মতো কারণে ফেটে পড়ছে, কিন্তু এই ক্রোধের গভীরে নিহিত আছে অর্থনৈতিক সংকট। দানসত্র চালিয়ে, ভিক্ষে দিয়ে সেই সংকট এবং তার ফলে জমে ওঠা ক্ষোভের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সামাজিক নিরাপত্তার নামে নানা রকম ভর্তুকির প্রকল্প চালিয়ে দারিদ্র পুনর্বণ্টন করা যায়, সত্যিকারের সমৃদ্ধি আনা যায় না। এই সত্যটি দেশের বহু মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এখন প্রবল ভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন। তাঁরা প্রসাদ বিতরণের কানাগলি থেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং তার উপযোগী সুশাসনের রাজপথে উত্তীর্ণ হতে চাইছেন। ভোটে তার প্রভাব পড়ছে। |
অনেকে বলবেন, এই যুক্তি নাগরিক ভারতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, গ্রামে নয়, সেখানে এখনও জাতপাত, ধর্ম বা অন্যান্য গোষ্ঠীগত পরিচয়ের ভিত্তিতেই ভোট পড়ে। এটা আগে সত্যি ছিল, এখন আর নয়, কারণ ভারতে অত্যন্ত দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। সামাজিক অর্থনৈতিক মন্থন চলছে, পুরনো সমাজকাঠামো ভেঙে যাচ্ছে, মানুষের চিন্তাভাবনা বদলাচ্ছে। গ্রাম আর শহরের মানুষের মানসিকতায় আগে যে পার্থক্য ছিল, আজ সেটা অনেক কমেছে, বিশেষত তরুণদের ক্ষেত্রে। এবং মনে রাখতে হবে, জনসংখ্যায় তরুণ প্রজন্মের অনুপাত অনেক বেড়েছে, ক্রমশই বাড়ছে। তাই বিহার বা উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যের গ্রামাঞ্চলেও এখন আয়বৃদ্ধি এবং সুশাসনের দাবি উত্তরোত্তর প্রবল হচ্ছে। ইন্ডিয়া বনাম ভারত-এর গল্পটা দ্রুত অচল হয়ে পড়ছে। গোটা দেশ এখন উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতে চায়। যিনি সেই স্বপ্ন দেখাতে পারবেন, ভোটদাতারা তাঁর প্রতি অনুকূল হবেন।
গুজরাতে অন্তত সে কথা অভ্রান্ত ভাবে প্রমাণিত। নরেন্দ্র মোদী উন্নয়নের মঞ্চে দাঁড়িয়ে সে রাজ্যে নির্বাচনী সাফল্য পেয়ে চলেছেন। শুধু শহরে নয়, গ্রামেও। এবং রাজ্যের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মধ্যেও। গুজরাতের একটি অংশেই বিজেপি ভোটে ভাল ফল করেনি, সেটা উত্তরাঞ্চলে। লক্ষণীয়, ওই অঞ্চলেই রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, পানীয় জল ইত্যাদির সরবরাহ এখনও ভাল নয়, সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলি যথেষ্ট সফল নয়। অর্থাৎ উন্নয়ন যথেষ্ট হয়নি বলেই মোদী সেখানে ভোট পাননি।
মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে দাঁড় করিয়ে গুজরাতের বাইরে বিজেপির কতটা লাভ হয়েছে? এ প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর দেওয়ার পথে দুটি বড় বাধা আছে। এক, কংগ্রেস এবং বিজেপি’র অর্থনৈতিক আদর্শ এবং কর্মসূচির মধ্যে ফারাকটা যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। হয়তো ক্রমশ অস্পষ্টতা কমবে, কিন্তু সেটা ভবিষ্যতের কথা। নরেন্দ্র মোদী তাঁর অর্থনৈতিক কর্মসূচি সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলছেন না। যেটুকু তাঁর কথাবার্তা থেকে অনুমান করা যাচ্ছে, বিজেপি’র অর্থনৈতিক ইস্তাহার বা ঘোষণা তার সঙ্গে কতটা মিলবে, বলা শক্ত।
দ্বিতীয়ত, বিজেপি বা তার নায়ক যা বলছেন আর বিজেপি শাসিত রাজ্যের সরকার যা করছে, দুইয়ের মধ্যে তফাত আছে। যেমন, মধ্যপ্রদেশে বা ছত্তীসগঢ়ে খাদ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভর্তুকির বহর বিরাট, এই প্রকল্পগুলি সে সব রাজ্যের সরকারি কর্মসূচির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। খাদ্যের গণবণ্টন কর্মসূচি রূপায়ণে রমন সিংহ যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তাতে সনিয়া গাঁধীর অখুশি হওয়ার কোনও কারণ নেই!
এই পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। স্বভাবতই ওই প্রশ্নটা নতুন করে আরও নির্দিষ্ট চেহারায় উঠে এসেছে: এই ফলাফলে নরেন্দ্র মোদীর কতটা প্রভাব আছে? তিনি কি কোনও জোয়ার আনতে পেরেছেন? যাকে বলে ‘ওয়েভ’ কিংবা ‘লহর’? এই প্রশ্নের উত্তরে আপাতত আমরা তিনটে কথা বলতে পারি।
এক, ‘ওয়েভ’ কাকে বলে? কথাটার অর্থ স্পষ্ট এবং নির্দিষ্ট করা দরকার, তা না হলে যখন যার যেমন সুবিধে, তখন সে সেই ভাবে এই কথাটাকে ব্যবহার করতে পারে, বস্তুত তা-ই করা হয়। দুই, কোনও বিধানসভা নির্বাচনকেই বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখা যায় না, রাজ্য স্তরের বিভিন্ন প্রশ্ন এবং রাজ্য নেতৃত্বের ভূমিকা তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। তিন, নির্বাচনের ফলাফলের কতটা কোন কারণে হয়েছে, সেটা কখনওই আলাদা করে জানা সম্ভব নয়। কোনও একটা কারণকে চিহ্নিত করাটা ভুল। মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানের উদাহরণ নেওয়া যাক। একটিতে বিজেপি সরকার ফিরে এল, আর একটিতে কংগ্রেসের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিল বিজেপি। ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ভোটদাতাদের যে বিরাগের কথা ‘অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি’ নামে পরিচিত, সেটা দিয়ে এই দুই ফলাফলের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করা যাবে না। ক্ষমতাসীন দল ফিরে এলে এখন ‘প্রো-ইনকাম্বেন্সি’র কথা বলা হয়ে থাকে, কিন্তু সেটা ব্যাখ্যা হিসেবে খুব জোরদার নয়, বরং যে ভাবে হোক একটা ব্যাখ্যা খাড়া করার চেষ্টা বলেই মনে হয়। বরং এখানে অন্য একটা ব্যাপার প্রাসঙ্গিক হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, ভোটদাতাদের রাগ বা বিরাগ ক্ষমতাসীন সরকার বা দলের বিরুদ্ধে ততটা নয়, যতটা গদিয়ান বিধায়ক বা সাংসদের বিরুদ্ধে। এই নির্বাচনে মধ্যপ্রদেশে ও ছত্তীসগঢ়ে আগের বারের বিধায়করা তুলনায় বেশি হেরেছেন, সেটা এই কারণে হওয়া সম্ভব।
এই প্রেক্ষাপটে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার দেখলে মনে হয়, আগের দুটি বিধানসভা নির্বাচনের ফল থেকে তারা যে হারে ভোট পাবে বলে মনে হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি পেয়েছে। ক্ষমতায় থাকার ফলে ভোটের হার কমে, এটা ধরে না নিলেও এই কথাটা মিথ্যে নয়। এই বাড়তি ভোটটার পিছনে নরেন্দ্র মোদীর একটা ভূমিকা আছে বলেই মনে হয়। তিনি প্রচারে নেতৃত্ব না দিলে মধ্যপ্রদেশে এবং রাজস্থানে বিজেপির এতটা ভাল ফল হয়তো হত না। ছত্তীসগঢ়ের ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সে রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে আসবে বলে মনে করছিল। বিশেষত বস্তার অঞ্চলে সহানুভূতি ভোটের হাওয়া তাদের লড়াইয়ে সাহায্য করবে, এটা ধরে নেওয়া হয়েছিল। আমার ধারণা, নরেন্দ্র মোদী না থাকলে কংগ্রেস ছত্তীসগঢ়ে জিতত। তিনি সেই লোকসান থেকে দলকে বাঁচাতে পেরেছেন।
দিল্লিতে আপ-এর আবির্ভাব নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক কথা হয়েছে। এটা নিশ্চয়ই এক চমকপ্রদ ঘটনা। তাৎপর্যপূর্ণও বটে। বিশেষ করে, দুর্নীতিবিরোধী মঞ্চ থেকে এই দলটি যে ভাবে জন্ম নিল, যে ভাবে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিজেকে গড়ে তুলল, তাকে ভারতীয় রাজনীতিতে একটি বিশেষ মুহূর্ত হিসেবে নিশ্চয়ই চিহ্নিত করা যায়। কমনওয়েলথ গেমস সংক্রান্ত দুর্নীতি, দিল্লি ধর্ষণ কাণ্ড, সামগ্রিক ভাবে প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও অহমিকা, এগুলো সবই এই উত্থানের পিছনে কাজ করেছে। কংগ্রেস এবং বিজেপি, দু’দলই আপ-এর গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। কিন্তু তার পরেও মোদীর ভূমিকা তুচ্ছ হয়ে যায় না। মনে রাখতে হবে, দিল্লিতে বিজেপি’র ভাবমূর্তিও ঠিক দুর্নীতিমুক্ত বলা চলে না। এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, সেই কারণেই মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীর নাম নিয়ে টানাপড়েন চলেছিল এবং শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদীর ইচ্ছা অনুসারেই সেই প্রার্থীর নাম স্থির হয়েছিল। সেটা না হলে, এবং দিল্লিতে মোদী কয়েকটি নির্বাচনী সভা না করলে, বিজেপির ফল আরও খারাপ হত এবং আপ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যেত। এ-সবই অনুমান, কিন্তু এই অনুমানগুলি বুঝিয়ে দেয়, বিজেপি’র পক্ষে মোদীর গুরুত্ব অস্বীকার করা যাচ্ছে না। ছত্তীসগঢ়ের মতো, দিল্লিতেও মোদী হয়তো বিরাট লাভ এনে দিতে পারেননি, কিন্তু লোকসান কমিয়েছেন।
মোদীর এই গুরুত্ব অন্তত আংশিক ভাবে তাঁর উন্নয়নী ভাবমূর্তির অবদান হতেই পারে। সেই ভাবমূর্তির সঙ্গে বিজেপি শাসিত রাজ্যের বাস্তব কতটা মেলে, সেটা অন্য তর্ক। আপাতত নির্বাচনী প্রচার চলবে। সেখানে ভাবমূর্তিই গুরুত্ব পাবে। বিহার বা উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে তার দাম কতখানি, সেটাই বড় প্রশ্ন।
দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ |