দেশের অন্য চার রাজ্যে যখন কংগ্রেস পর্যুদস্ত, তখন মিজোরামের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল তাহাকে কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা দিতে পারিত, যদি অবশিষ্ট দেশের রাজনীতিতে সেই ফলাফলের কোনও কার্যকর প্রভাব থাকিত। কংগ্রেসের দুর্ভাগ্য, মিজোরাম বিধানসভার নির্বাচনী ফলাফল এমনকী অবশিষ্ট উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নির্বাচনকেও প্রভাবিত করিতে সমর্থ নয়। তথাপি রাজ্যের নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিতে এই ফল তাৎপর্যহীন নয়। জনজাতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদের অবসানে মিজোরাম ১৯৮৭ সালে স্বতন্ত্র রাজ্য হিসাবে গণ্য হইবার পরে কংগ্রেস মোট চার বার ক্ষমতাসীন হইল। তাহার মধ্যে উপর্যুপরি দুই বার তাহার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়িয়াছে। প্রদেশ নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী লালথানহাওলা স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত।
মিজোরাম এখন একটি স্থিতিশীল জনপদ। মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের লালডেঙা সেখানে যে বিদ্রোহের পতাকা উড়াইয়াছিলেন, তাহা মিজো চুক্তির পরই নামাইয়া লওয়া হয়। তদবধি সীমান্তবর্তী এই রাজ্য আর নয়াদিল্লির সহিত বিরোধে যায় নাই, বরং যখন যে দল কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকিয়াছে, তখন তাহার সহিত রফা করিয়া রাজ্যের তহবিল বাড়াইয়া লইয়াছে। এ জন্যই বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ যখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল, সেই সময় অর্থাৎ ১৯৯৮ ও ২০০৩ সালের ভোটে কংগ্রেস নয়, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টই রাজ্যে শাসনক্ষমতা হাসিল করিয়াছিল। এনডিএ-র বিদায়ের সঙ্গে-সঙ্গে রাজ্য আবার কংগ্রেসের পতাকার নীচে সমাবেশিত। কারণটি সহজবোধ্য। অনেক দিনের রক্তাক্ত লড়াইয়ের পর মিজোরা শান্তি ও উন্নয়ন চান। সে জন্য রাজনৈতিক স্থিতি প্রয়োজনীয়। তাই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যের মতো এখানে পাইকারি দলবদলের ঘটনা বিশেষ ঘটে না। ঘোড়া কেনাবেচা করিয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টিও রাজ্যবাসীর পছন্দ নয়। যে দল শান্তি, স্থিতি, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিবে, মিজোরা তাহার সঙ্গেই আপন ভাগ্য জুড়িয়া লইতে প্রস্তুত। মিজোরামের নিজস্ব অর্থনীতি বলিতে বিশেষ কিছু নাই। নয়াদিল্লি হইতে প্রাপ্ত তহবিলের উপর নির্ভর করিয়াই তাহার দিন গুজরান হয়। তাই দিল্লির শাসক দল বা গোষ্ঠীর সহিত সুসম্পর্ক রাখিয়া চলাই মিজোরামের রাজনীতিকদের একটি বড় লক্ষ্য।
কেন্দ্র কিন্তু মিজোরামের বা অবশিষ্ট উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও বিকাশের প্রশ্নটিকে উপেক্ষাই করিয়া থাকে। ‘পূর্বদিকে তাকাইবার’ যে-নীতির কথা নরসিংহ রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের কাল হইতে শুনা যাইতেছে, তাহাকে গুরুত্ব দিলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সহিত নিবিড় আর্থিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়িয়া তুলিতে মিজোরাম হইতে পারিত অন্যতম করিডর। চিন, মায়ানমার, তাইল্যান্ড অভিমুখী যে ব্যবসাবাণিজ্যের গমনপথ-- মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা ও মণিপুর ভেদ করিয়াই তো তাহা অগ্রসর হইবে। তাহা সম্ভব করিতে হইলে সমগ্র উত্তর-পূর্বের আর্থিক ও সামাজিক পরিকাঠামো, রাস্তাঘাট, বাণিজ্য ও পর্যটনকেন্দ্রগুলি ঢালিয়া সাজানো দরকার। দরকার আধুনিক যান-চলাচলের উপযোগী উন্নত পথঘাট, সেতু, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ। এই সব আয়োজন মিজোরাম-সহ সমগ্র অঞ্চলের অর্থনীতিকেই আমূল পাল্টাইয়া দিতে পারে। মিজোরামকে তখন আর কেন্দ্রের ডোল-কম্বলের উপর নির্ভর করিতে হইবে না। তেমন সুদিনের অপেক্ষা আরও কত দীর্ঘ হইবে, বলা কঠিন। |