যেখান থেকে যত চাপই আসুক, তিনি ইস্তফা দেবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান তথা সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়।
এক মহিলা ইন্টার্নকে যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত অশোকবাবু মঙ্গলবার বলেন, “অনেকেই অনেক দিন ধরে আমার ইস্তফা চাইছেন। কেন ইস্তফা দেব? আমি যেমন আছি, তেমনই থাকব।” তাঁর ইস্তফা নিয়ে কয়েক দিন ধরেই জল্পনা চলছে। কিন্তু অশোকবাবু এত দিন পরিষ্কার করে কিছু বলেননি। এই প্রথম তিনি স্পষ্ট করে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। এবং সেটা জানালেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসেই। তিনি যে ইস্তফা দেবেন না, অশোকবাবু সেটা আনন্দবাজারকে তো জানিয়েছেনই, রাজ্য মানবাধিকার কমিশন সূত্রের খবর, ঘনিষ্ঠ মহলেও এ দিন তিনি বলে দিয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে যে-অভিযোগ উঠেছে, তার শেষ দেখে ছাড়বেন। |
চাপ বাড়ছে, তবে রণে ভঙ্গ দিতে নারাজ তিনিও। মানবাধিকার
দিবসের অনুষ্ঠানে অশোক গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: প্রদীপ আদক। |
এ দিনই অশোকবাবুর পদত্যাগের দাবি জানিয়ে সংসদে সরব হয় তৃণমূল। তাঁর অপসারণ দাবি করে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে আগেই দু’টি চিঠি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লিতে তিন দিনের সফরে আসা মমতার সঙ্গে আজ, বুধবার রাষ্ট্রপতির বৈঠক হওয়ার কথা। তার আগে বিষয়টি নিয়ে চাপ বাড়াতে এ দিন রাজ্যসভায় অশোকবাবুর পদত্যাগ দাবি করে সরব হয় তৃণমূল। তার জেরে দফায় দফায় মুলতুবি করে দিতে হয় রাজ্যসভার অধিবেশন।
তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, প্রাথমিক সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে দোষী সাব্যস্ত করেছে সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের কমিটি। দল মনে করে, তিনি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান-পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। তিনি ইস্তফা না-দেওয়া পর্যন্ত সংসদে সরব থাকবে দল। রাজ্যসভায় তৃণমূলের মুখ্য সচেতক ডেরেক ও’ব্রায়ান বলেন, “সব বড় দল এ বিষয়ে আমাদের পাশে রয়েছে। সকলেই আমাদের দাবি সমর্থন করেছে।”
বুধবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর নির্ধারিত বৈঠককে মমতা নিজে ‘সৌজন্য-সাক্ষাৎ’ বললেও দলের একাংশের বক্তব্য, সেখানে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিষয়ে আলোচনার সম্ভাবনা ষোলো আনা। দলের বক্তব্য, খোদ তৃণমূল নেত্রী মনে করেন, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান-পদে থাকার যোগ্যতা খুইয়েছেন। রাজ্য সরকার আশা করেছিল, তিনি নিজে থেকে ইস্তফা দেবেন। তা হলে আর বিরোধের পরিস্থিতি তৈরি হত না। তা না-করে ইস্তফার প্রশ্নে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় অনমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছেন। তাই দলের পক্ষ থেকেও বিষয়টি নিয়ে সংসদের উভয় কক্ষে জনমত তৈরি করে তাঁর বিরুদ্ধে চাপ বাড়ানোর কৌশল নিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। ডেরেক বলেন, “বুধবার রাজ্যসভায় প্রশ্নোত্তর পর্ব মুলতুবি করে এ বিষয়ে আলোচনার দাবি জানানো হবে।” আজ লোকসভাতেও জিরো আওয়ারে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার দাবি জানাবেন তৃণমূল সাংসদেরা।
ডেরেক ট্যুইটারেও অশোকবাবুকে কমিশন থেকে ইস্তফা দিতে বলেছেন। তাঁর কথায়, “আজ (মঙ্গলবার) রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার দিবস। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় এখনও পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ আঁকড়ে রয়েছেন। স্যার, আপনার এই পদকে দয়া করে হাস্যকর বানিয়ে তুলবেন না।”
যৌন হেনস্থার অভিযোগের তদন্ত করে সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতির কমিটি ৫ ডিসেম্বর জানিয়ে দিয়েছিল, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ওই মহিলা ইন্টার্নের সঙ্গে ‘অবাঞ্ছিত আচরণ’ করেছেন। তার পর থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক মহলে দাবি ওঠে, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ইস্তফা দিন।
তবে এ দিন ফের অশোকবাবুর পাশে দাঁড়িয়েছেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার ও বর্ষীয়ান আইনজীবী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি। পরে সাংবাদিকেরা সোমনাথবাবুকে প্রশ্ন করেন, কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের সরে দাঁড়ানো উচিত কি না?
সোমনাথবাবু বলেন, “এক জন অভিযোগ করলেই তো হল না। আগে অভিযোগ প্রমাণিত হোক। দোষী হলে দেশ শাস্তি দেবে।” এই ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টেরও সমালোচনা করেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার। সোমনাথবাবু বলেন, “আমি জানি না, কোন অধিকারবলে সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে (বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ) হস্তক্ষেপ করল এবং তার পরে আবার সিদ্ধান্ত নিল, এই ধরনের কোনও বিষয়ে তাদের কিছুই করার নেই। তা হলে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হল কেন?”
তা হলে কি কোনও দুরভিসন্ধি রয়েছে? সোমনাথবাবু বলেন, “দুরভিসন্ধি নয়। আমি বলব, এটা অতি-উৎসাহী হয়ে করা হয়েছে।”
এ দিনের ওই অনুষ্ঠানে খোদ কমিশনের চেয়ারম্যান উপস্থিত থাকবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। তবে যাবতীয় জল্পনায় জল ঢেলে দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। গত বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত ছুটিতে থাকার পরে এ দিন তিনি কমিশনের কার্যালয়ে যান, স্বাভাবিক কাজকর্ম করেন। তার পরে বিকেলে ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কলকাতা হাইকোর্টের সার্ধশতবার্ষিকী ভবনের ১০তলার প্রেক্ষাগৃহে পৌঁছন। রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায়, রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যয় এবং অন্য অতিথি-অভ্যাগতদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানান তিনি।
এ দিনের অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্রের থাকার কথা ছিল। কিন্তু তিনি যাননি। কমিশন সূত্রে অবশ্য জানানো হয়েছে, শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রধান বিচারপতি আসতে পারেননি।
|