সুপারির খোসা ছাড়িয়ে সিদ্ধ করে তা রোদে শুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। পরে তা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন আড়তদাররা। বসিরহাটের বাদুড়িয়া থানার বেশ কিছু গ্রামে সুপারির এই ধরনের ব্যবসায় অনেকেই লাভের মুখ দেখেছেন। আড়তদারদের দাবি গত তিন মাসে ওই ব্যবসায় প্রায় এক লক্ষ টাকা লাভ হয়েছে। অন্যদিকে, দৈনিক কমপক্ষে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আয়ের মুখ দেখছে পরিবারগুলিও। লাভের অঙ্ক দেখে বহু পরিবারে ছোট থেকে বড় সকলেই হাত লাগিয়েছেন এই কাজে। স্থানীয় ভাবে এই প্রক্রিয়াকে বলা হচ্ছে ‘সুপারি সিজার’। ব্যবসায় লাভের সম্ভাবনা দেখে অনেকেই আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হতে এই কাজে নেমেছেন। |
বাদুড়িয়ার শুকপুকুর, আড়বালিয়া, বৈকারা, সর্দারপাড়া, উত্তর দিয়াড়া, তিলডাঙা, আরশুলা গ্রামে গেলে চোখে পড়বে ঘরে ঘরে সুপারির খোসা ছাড়িয়ে চলেছেন মহিলারা। বহু ক্ষেত্রে হাত লাগিয়েছে ছোটরাও। পুরুষরাই মূলত গ্রামে গ্রামে ঘুরে সুপারি জোগাড় করে আনছেন। খোসা ছাড়ানোর পরে সুপারি গরম জলে ভাল করে সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে ফো হচ্ছে। সেই সুপারি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন আড়তদারেরা।
কিন্তু সুপারি পাওয়ার পদ্ধাতিতে হটাৎ এই বদল কেন?
আগে সুপারি ছাড়িয়ে রোদে শুকিয়ে দোকানে বা ব্যবসায়ীদের কাছে চলে যেত। কিন্তু সে ক্ষেত্রে অল্প দিনেই তা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। নতুন পদ্ধাতিতে কাঁচাসুপারি খোসা ছাড়িয়ে তা থেকে সুপারি বের করে সিদ্ধ করে শুকিয়ে নেওয়ায় তা অনেকদিন ধরে ভাল রাখা যায়। আড়শুলা গ্রামের আড়তদার আবদুর রজ্জাক বিশ্বাস, আসরাফ বিশ্বাস বলেন, “ফুলো সুপারি সাধারণত নরম হওয়ায় অল্প দিনেই নষ্ট হয়ে যায়। সে জন্য তা কেনার পরে ভাল করে সিদ্ধ করলে একটা সুন্দর রং হয়, শক্ত হওয়ার পরে অনেক দিন ভাল থাকে।” তাঁরা বলেন, “আমরা ১০ জন তিন মাসের এই ব্যবসায় আড়াই লাখ টাকা বিনিয়োগ করে প্রায় এক লাখ টাকা মতো লাভ করেছি।”
বৈকারা গ্রামের রূপা বিবি বলেন, “এক কেজি সুপারি ছাড়িয়ে ৩ টাকা পাওয়া যায়। সারা দিনের কাজ সামলে দিনে ১৪-১৫ কেজি সুপারি ছাড়াতে পারি। ৫-৬ জনের পরিবারে সকলে মিলে কাজ করলে প্রতিদিন ২০০ টাকার মতো রোজগার হয়। অভাবের সংসারে এটা বড় কাজ দিয়েছে।” অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রেশমা খাতুন বলে, “পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে সুপারি সিজার করি। এতে যেমন পরিবারের সাহায্য হয়, তেমনই নিজেদের হাত খরচটাও জোগাড় হয়ে যায়।”
স্থানীয় বাসিন্দা সুব্রত বিশ্বাস, খলিল মণ্ডল বলেন, “গত কয়েক বছর ধরে আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ, এই তিন মাসে সুপারি সিজারের কাজে কিছুটা আর্থিক সুবিধা হয়েছে।” খলিলের কথায়, “বছরের অন্য সময়ে আলু, ফুলকপি-সহ অন্যান্য ফসলের চাষ করি। আম, কাঁঠাল বাগান কিনে ব্যবসাও করে অনেকে। কিন্তু এই সময়টায় গ্রামে গ্রামে ঘুরে সুপারি জোগাড় করে আনি। অনেকে আবার সুপারির বাগান কিনে নিয়ে ব্যবসাও শুরু করেছে।” গ্রামবাসীরা জানান, আকৃতির অনুপাতে সুপারির দামের তারতম্য হয়। তবে গুণতিতে ১০০টি সুপারির ওজন ছ’শো গ্রাম হয়। তা কিনতে ২০-৩০ টাকা খরচ হয়। একটু বড় সুপারি হলে দাম পড়ে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। ওই সুপারি বাড়িতে আনার পরে তা ছাড়ানোর জন্য গ্রামের মেয়েদের দেওয়া হয়। গুণতিতে ১৪০ থেকে ১৫০টি ছাড়ানো সুপারিতে এক কেজি হয়। ১ কেজি ছাড়ানো সুপারি ৭০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। সেইগুলিকে ফুলো বলে। ফুলো সুপারি কেনার পরে তা গরম জলে ভাল করে সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে নিলে শক্ত হয়। ব্যবসায়ীরা এসে পান মশলা তৈরির জন্য ওই সুপারি কিনে নিয়ে যান। বাদুড়িয়ার পুরপ্রধান দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “স্থানীয় বৈকারা, আড়বেলিয়া প্রভৃতি গ্রামের অনেকে দাদন দিয়ে সুপারি গাছ কিনে ব্যবসা করেন। লাভজনক ব্যবসা হলেও অনেক সময় পরিমাণ মতো সুপারি না হওয়ায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। তবু যে ভাবে আর্থিক স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টায় অনেকে এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন তা উল্লেখযোগ্য।” পাশাপাশি তিনি এও জানান, সরকার যদি আর্থিক ভাবে ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ব্যবসার আরও শ্রীবৃদ্ধি হবে।
গ্রামবাসীদের বক্তব্য, কয়েক বছর ধরে চলা এই ব্যবসা এখন এই এলাকায় একটা শিল্পে পরিণত হয়েছে। সরকারি সাহায্য পেলে আরও অনেক মানুষ এতে যুক্ত হয়ে আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হতে পারেন। |