প্রবন্ধ ১...
বড় দল ও পণ্ডিতদের তাচ্ছিল্য পেরিয়ে
দেশের ‘রাজনৈতিক শ্রেণি’র প্রধান ব্যক্তিবর্গকেও তা হলে এখন ‘গতানুগতিক’ রাজনীতির সীমাবদ্ধতা ও ‘বিকল্প’ রাজনীতির সম্ভাবনার কথা ভাবতে হচ্ছে। কিছু দিন আগেও বিকল্প রাজনীতিকে নিতান্ত শহুরে হুজুগ, বিভ্রান্ত নাগরিক সমাজের দায়িত্বজ্ঞানহীন আস্ফালন, বা দূরসঞ্চারী ইন্টারনেট-নির্ভর সোশ্যাল মিডিয়া-কেন্দ্রিক ছেলেমানুষি বলে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর বড়দা-রা জাতীয় টিভি চ্যানেলসমূহের সান্ধ্য প্রাইম টাইম মাতিয়ে রাখতেন, এবং এ হেন ‘নাদান’ বালখিল্যদের প্রতি করুণাঘন উপদেশ বর্ষাতেন, তাঁরা এখন কোন বর্ষাতির আড়ালে নিজেদের শ্রীমুখ লুকোবেন, ঠিক করতে পারছেন না।
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির (আপ) ঝাড়ুতে কংগ্রেস ধূলিসাৎ। আর পনেরো বছর অভুক্ত থাকার পর, হাঁপাতে হাঁপাতে ক্ষমতার হেঁশেলে ঢোকার মুখে বিজেপি দেখেছে, রান্না শেষ, টেবিল সাজানো হয়েছে, শুধু প্রবেশপথ আর ক্ষমতার টেবিলের মাঝে ব্যারিকেড করে দাঁড়িয়ে আছে আঠাশটি ঝাড়ু! ফলে, তাদের বাড়া ভাতে ছাই পড়তে চলেছে। এই ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা থেকে বিজেপি আদৌ মুক্ত হয় কি না, কী করে, কোন বঙ্কিম পথে, তা সম্ভব হয়, বা কংগ্রেস ও অন্যদের সাহায্যে আপ নিজেই ক্ষমতায় যায়, বা ত্রিশঙ্কু দশা কাটাতে বিধানসভা ভেঙে ফের ভোটের আয়োজন করতে হয় এ সবই ক’দিন জাতীয় রাজনীতির অন্যতম আলোচ্য হয়ে থাকবে, কিন্তু নিছক ক্ষমতা দখলের বাইরে আপ-এর এই সম্ভ্রম জাগানো উত্থান এমন কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল, যা সাড়ে ছয় দশকের ‘গতানুগতিক’ রাজনীতির প্রেক্ষিতে অভূতপূর্ব।
আপ-এর এই প্রজ্বলিত প্রদীপের পিছনেও কিন্তু আছে সলতে পাকানোর ইতিহাস। আড়াই বছর আগে, কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্নীতি রুখতে জন-লোকপাল গঠনের দাবিতে দিল্লির রাজপথ অণ্ণা হাজারে ও তাঁর তরুণতর সঙ্গীদের (অরবিন্দ কেজরিওয়াল ছিলেন যাঁদের অন্যতম) অনশন-ধর্নায় উত্তাল হয়ে উঠেছিল, বিশিষ্টজন থেকে প্রকৃত অর্থে গৌড়জন, বা আম আদমির যোগদানে সেই প্রতিবাদ-প্রাঙ্গণ প্রতিদিন স্ফীততর হয়ে উঠছিল, তারই মধ্যে ছিল আজকের আপ-এর বীজ। বা, এক বছর আগে, এমনই ডিসেম্বরের এক রাতে দিল্লির মুনিরকা বাসস্টপে বন্ধুর সঙ্গে বাসে চেপে তরুণীটি নরপিশাচদের নির্মমতম অত্যাচারের শিকার হলে তার প্রতিবাদে সৃষ্টি হয়েছিল এ কালের অন্যতম পথে নামার ইতিহাস রাজধানীতে এবং সারা দেশে, তার মধ্যে ছিল আট মাস আগে তৈরি হওয়া আপ-এর সাহস। আর, এই ধর্ষণ-হত্যা দিল্লির প্রবল শীতে খোলা আকাশের তলায় যে অযুতসংখ্যক তরুণতরুণীকে (লেখাপড়ায় ঝকঝকে ছাত্রছাত্রীরা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন অতি সাধারণ ও দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরা) সারা রাত অকুতোভয়ে জড়ো করেছিল, জল-কামানের তীব্র বারিস্রোত যাদের বিচ্যুত করতে পারেনি, তার মধ্যে প্রোথিত ছিল আম আদমির স্পর্ধা।
সম্মার্জনা। আপ সমর্থকদের সমাবেশ। দিল্লি, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৩। ছবি: এ এফ পি।
এই সব কিছু সম্বল করে, আট মাস আগে প্রাক্তন আই এ এস অরবিন্দ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্তভূষণ, বা ভারতের অন্যতম ভোটবিজ্ঞানী, দিল্লির সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজ-এর শিক্ষক যোগেন্দ্র যাদব প্রমুখের উদ্যোগে যখন আপ গঠিত হয়, তখন অনেক সবজান্তা সমাজবিজ্ঞানী মুখ টিপে হেসেছিলেন। এঁদের একাংশের তাত্ত্বিক বিশ্বাস, নাগরিক অধিকার ও কর্তব্যের ধারণায় গড়ে ওঠা ‘নাগরিক সমাজ’ এবং দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর তাগিদে নিম্নবর্গীয় মানুষের ‘রাজনৈতিক সমাজ’-এর মধ্যে রয়েছে দুরতিক্রম্য ব্যবধান, ফলে নাগরিক সমাজের (যা রাজনৈতিক দল নয়) কর্মকাণ্ড তথা আন্দোলন কখনওই নিম্নবর্গীয় রাজনৈতিক সমাজের সমর্থন (যা না পেলে তৃতীয় বিশ্বে রাজনৈতিক সাফল্য অধরা থাকবে) পেতে পারে না। এর পাশাপাশি ছিল প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক বড়দাদের করুণাময় তাচ্ছিল্য: ‘এ বার বাছারা বুঝবে, কত ধানে কত চাল!’
অন্য দিকে, এই আট মাসে নবজাতক দলটি গতানুগতিক রাজনীতির চেনা পথ ছেড়ে উদ্ভাবন করছিল জনরাজনীতির বিকল্প পথ। মুখ্যত, কেন্দ্রীয় সরকার ও দিল্লির রাজ্য সরকারের দুর্নীতিকে সামনে রেখে পথ চললেও আপ অন্য দলগুলোর মতো ভোটে লড়ার জন্য কোনও কেন্দ্রীয় তথা সাধারণ স্ট্র্যাটেজি ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়নি। এমনকী একটি সাধারণ নির্বাচনী ইস্তেহারও রচনা করেনি। বরং দিল্লির সত্তরটি বিধানসভা কেন্দ্রের জন্য নির্দিষ্ট প্রয়োজনভিত্তিক ইস্তেহার রচনা করেছিল, সেই সব কেন্দ্রের মানুষজনের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ চালানোর পরেই। এর পর তারা এক একটি বিধানসভা অঞ্চলকে ন’টি ক্ষেত্রে ভাগ করে, দিনের পর দিন ওই ক্ষেত্রের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে প্রচার-যোগাযোগ চালায়, নরেন্দ্র মোদীর মতো কোনও চোখধাঁধানো র্যালি না করেই। এই কাজ সফল করতে পথে নেমেছিল দলীয় রাজনীতিতে কার্যত অনভিজ্ঞ সেই যুবসমাজ, যারা গত আড়াই বছর ধরে দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি, নিরাপত্তার মতো বিষয়ে হাতে ঝাড়ু (আপ-এর নির্বাচনী প্রতীক) নিয়ে পথে নেমে এসেছে। আওয়াজ উঠেছে: ইস বার ঝাড়ু চলেগি। এবং ভোট শেষে দেখা গেল, সম্মার্জনীর এই প্রবল প্রহারে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস তো মুছে গেছেই, বিজেপির কপাল কুঁচকে গেছে।
আর আম আদমি? তাদের যদি প্রবল জনসমর্থন না থাকত, তবে কি এই প্রবল সাফল্য আসত? দিল্লির প্রায় সব ক’টি ক্ষেত্র থেকেই তারা হয় জিতেছে, নয় প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এমনকী দিল্লি রাজ্যের উত্তর-পশ্চিমের হরিয়ানা-ঘেঁষা প্রান্ত নারেলা অঞ্চল, যেখানে নিম্নবর্গীয় প্রবাসী শ্রমিকরাই সংখ্যাধিক, সেখানেও ‘ঝাড়ু’ চলেছে। এর একটা বড় কারণ, জনআন্দোলনের কৃৎকৌশলে পারদর্শী অরবিন্দরা ওই অঞ্চলের মানুষকেও যুক্ত করেছেন তাঁদের নিজস্ব নির্বাচনী ইস্তেহার রচনার কাজে। এই ভাবে বড় রাজনৈতিক দলের কাছে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্রাত্য, এবং তাদের কাছে কেবল দয়ার উচ্ছিষ্ট পেতে অভ্যস্ত প্রান্তিক মানুষেরাও তাঁদের যুগসঞ্চিত নিষ্ক্রিয়তার জাড্য কাটিয়ে ‘নতুন’ রাজনীতিতে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।
এই নয়া রাজনীতির ধাক্কায় মিডিয়াকথিত ‘মোদী ম্যাজিক’ও অনেকটা ফিকে লাগছে। দিল্লি বাদে পশ্চিম ও মধ্য ভারতের অন্য তিনটি রাজ্যে এমনিতেই বিজেপির যথেষ্ট শক্তপোক্ত সংগঠন ও কর্মকুশলী প্রবল নেতৃত্ব আছে, তাই এই সব জায়গায় বিজেপির জয়ে (রাজস্থানে অভূতপূর্ব ভাবে, মধ্যপ্রদেশে প্রবল ভাবে আর ছত্তীসগঢ়ে কুড়িয়েবাড়িয়ে) কতটা সংগঠনের, কতটা রাজ্য নেতৃত্বের, কতটাই বা মোদীর গুণে, তা নির্ণয় করা কঠিন। কোনও একটিকে চূড়ান্ত গুরুত্ব দিলে, অন্য উপাদানগুলোকে খাটো করতে হয়। যার ফলে সংগঠনের অভ্যন্তরেই গোল বাধতে পারে, যা আগামী লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি বা মোদী কারও পক্ষেই ভাল নয়। কিন্তু দিল্লির ভোট প্রমাণ করে ছাড়ল, সততা, সদিচ্ছা আর ভাল স্ট্র্যাটেজির যথাযথ মিশেলে যদি সত্যিকারের জনরাজনীতি করা যায়, তবে সুবিশাল র্যালির হুঙ্কার বা মিডিয়ার নিত্যবন্দনাও খুব একটা কাজে আসে না। এটা কেবল কংগ্রেস বা বিজেপি নয়, বামপন্থীদেরও শিক্ষণীয়, যাঁরা তৃতীয় বা চতুর্থ ফ্রন্ট গড়ার উচ্চাশায় নিজেদের চালু রাজনীতির খামতি না সারিয়ে, বিভিন্ন (বেশির ভাগ সময়েই দুর্নীতিগ্রস্ত, দাগি) আঞ্চলিক মনসবদার-নেতার হাত ধরে স্বর্গীয় পুলক লাভ করেন!
বিস্ময়ের অভিঘাত পেরিয়ে প্রশ্নও জাগছে কিছু। আপ-এর এই সাফল্য কি কেবল দিল্লি তথা বড় শহরকেন্দ্রিক? জাতীয় রাজনীতির বড় প্রেক্ষিতে যেখানে ‘দুর্নীতি’ নয়, জাতপাত, সম্প্রদায় বা কৌম পরিচয় অনেক বড় নির্ণায়ক এই দলের সম্ভাবনা কতটা? প্রশ্নটা তুচ্ছ করার নয় নিশ্চয়ই। কিন্তু ব্যাপারটাকে অন্য ভাবেও ভাবা যায়। যদি, সারা ভারতে না ছড়িয়ে কিছু বড় শহরেও আপাতত এই নতুন রাজনীতিচর্চা চলতে থাকে, তা হলে তার প্রভাবে শহরের তরুণ সম্প্রদায়ের একটা আদর্শবাদী অংশকে পাশে পাওয়া যাবে, যাঁদের অনেকেই আর গতানুগতিক প্রতিষ্ঠিত দলীয় রাজনীতিতে আকৃষ্ট হচ্ছেন না। এই তরুণদের অনেকেই তাঁদের জীবনীশক্তি ও বৈদ্যুতিন-যোগাযোগ-দক্ষতায় নীতিনির্ধারকদের অনেক বেশি প্রভাবিত করতে পারেন।
অন্য একটি প্রশ্ন করলেন রাজ্য কংগ্রেসের এক চেনা নেতা। টিভি চ্যানেলে ফলাফলের বিশ্লেষণী আলোচনা শেষে গাড়িতে উঠতে উঠতে বললেন, কিন্তু ক্ষমতায় না গিয়ে, কোনও দায়িত্ব না নিয়ে, কেবল সমালোচনা করে এরা কোথায় পৌঁছতে চাইছে? তাঁর ধাবমান গাড়ির দিকে চেয়ে ভাবলাম, এটাই তো এঁরা করতে চাইছেন। রাজনীতিকে কেবল ক্ষমতা দখলের নিরিখে না দেখে সৎ ও নিরলস ভাবে সমালোচনামূলক/ ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিতে দেখা। সেটাই বা কম কী?

শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.