|
|
|
|
না-ভোটে বড়সড় ওঠাপড়ার আঁচ দিল ৫ রাজ্য |
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • নয়াদিল্লি
১০ ডিসেম্বর |
প্রথম পরীক্ষাতেই পাল্টে দিয়েছে অনেকের ভবিষ্যৎ। লোকসভা ভোটে কী হবে? ভোটে অপছন্দের অধিকার কতটা পাল্টে দেবে দেশের রাজনীতি, সরকার বা প্রশাসনের হাল? ৫ রাজ্যে ভোটের ফল বেরোনোর পর এখন সেই অঙ্ক কষছেন সমাজমনস্তত্ত্ববিদ থেকে রাজনীতিক, এমনকী আম ভোটাররা। কারও মতে ভবিষ্যতে অনেক বড়সড় বদল ঘাটিয়ে দিতে পারে এই ব্যবস্থা। ছত্তীসগঢ়ের নির্বাচনী ফল দেখে মাওবাদীদের হাতে এর অপব্যবহার নিয়েও ভাবতে হচ্ছে কেন্দ্রকে। কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হুরিয়ত কনফারেন্সের নেতারা আবার আগাম স্বাগত জানাতে শুরু করেছেন না-ভোটের অধিকারকে। এতেও চিন্তায় পড়েছে রাজনৈতিক দলগুলি।
কিন্তু এমনিই যাঁরা ভোট দেন না! পুলিশ মানেই খারাপ, আর নেতারা চোর। ভোট দিয়ে হবেটা কী? দেশের গণতন্ত্রকে এমন সিধেসাপটা জবাব দিয়ে এত দিন যাঁরা ভোটের দিনে নির্ভেজাল ছুটি কাটিয়েছেন, নতুন করে ভাবতে হচ্ছে তাঁদেরও।
সৌজন্যে সুপ্রিম কোর্ট ও নির্বাচন কমিশন। পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে এ বারেই প্রথম বাড়তি একটি বোতাম যোগ হয়েছে ভোটযন্ত্রে। কেউ নয় বা নান অব দ্য অ্যাভাব। সংক্ষেপে নোটা। কোনও প্রার্থীকেই পছন্দ না হলে এই বোতাম টিপে তা জানিয়েছেন পাঁচ রাজ্যের ১৬ লক্ষ মানুষ।
যদিও সব মিলিয়ে মোট ভোটের ১ শতাংশের আশপাশেই ঘোরাফেরা করেছে নোটার প্রয়োগ। তবু ওই সামান্য শতাংশও কোনও প্রার্থীর ঝুলিতে গেলে বদলে যেতে পারত অনেকের ভাগ্য। অনেকে বলছেন, দিল্লিতে আম আদমি পার্টিকে ভোট দেওয়াটাও কতকটা নোটা অধিকার প্রয়োগ করার সমান। চিরাচরিত কোনও দলকেই যাঁদের পছন্দ নয়, তাঁরাই অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো ভোট-ময়দানে নতুন উঠে আসা মুখেই ভরসা খুঁজেছেন। তাই তাঁর প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। যদিও না-ভোটের ধাক্কা সামলাতে হয়েছে তাদেরও। দিল্লির রামকৃষ্ণপুরম কেন্দ্রে তাদের প্রার্থী সাজিয়া ইলমি মাত্র ৩২৬ ভোটে হেরেছেন। সেখানে নোটা ভোট দিয়েছেন ৫২৮ জন।
আম আদমির জন্য কাজ করতে চাওয়া অপরীক্ষিত প্রার্থীরাও এ ভাবে প্রথম যাত্রাতেই প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় কপালে ভাঁজ পড়েছে অনেক নেতার। বিভিন্ন দলের নেতারা ঘরোয়া ভাবে বলতে শুরু করেছেন, অন্যান্য রাজ্য, মায় গোটা দেশ যখন এই অধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবে, তাতে গায়ে লাগার মতো অনেক বড়সড় ওঠাপড়াও ঘটে যেতে পারে। বিশেষ করে যাঁরা অনেক দিন ধরে নির্বাচনী রাজনীতিতে রয়েছেন। যেমন, মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিংহ চৌহান। তাঁর কেন্দ্র বিদিশায় নোটা ভোট পড়েছে ৪,১১২টি। বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়ার কেন্দ্রেও ৩,৭২৯ জন ভোটার জানিয়েছেন, নাপসন্দ সব প্রার্থীই। ছত্তীসগঢ়ে মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহের রাজনন্দগাঁওয়ে নোটা বোতামে চাপ দিয়েছেন ২,০৪২ জন। শীলা দীক্ষিত ও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কেন্দ্র নয়াদিল্লিতে ১৩ জনকে পিছনে ফেলে পাঁচ নম্বর স্থানটি পেয়েছে নোটা। এখানে নোটা ভোট পড়েছে ৪৬০টি।
এ তো গেল হেভিওয়েট কেন্দ্রের কথা। সাধারণ কিছু কেন্দ্রেও ওলট-পালট করে দিয়েছে নোটা। যেমন ছত্তীসগঢ়ে মোহালা-মানপুর কেন্দ্রে জয়ী ও দ্বিতীয় স্থান পাওয়া প্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান মাত্র ৯৫৬ ভোটের। কিন্তু সেখানে নোটার ভোট ৫ হাজার ৭৪২। দন্তেওয়াড়ায় বিজয়ী প্রার্থীর জয়ের ব্যবধান প্রায় ৬ হাজার। কিন্তু নোটা প্রায় ১০ হাজার।
এই নাপসন্দের কথা অবশ্য আগেও জানানো যেত। কাগজে লিখে। ফলে পরিচয় গোপন থাকত না। নয়া ব্যবস্থায় পরিচয় গোপন থাকছে। সমাজমনস্তত্ত্ববিদ আশিস নন্দীর মতে, “কয়েক দশক ধরেই পুলিশ, নেতা ও আমলাদের উপরে বিপুল ক্ষোভ ও অসন্তোষ জমছে মানুষের। এমনিতে তাঁদের বলার কোনও সুযোগ থাকে না। নোটা যে তাদের এই অধিকার এনে দিয়েছে, সেটা খুব ভাল লক্ষণ।”
কিন্তু এর একটা আশঙ্কার দিকও আছে। নোটা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেই যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তাদের বক্তব্য, এ দেশে মাওবাদী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আস্থা রাখেন না। তারা এই বোতামের অপব্যবহার করতে পারে। ছত্তীসগঢ়েই এর আঁচ মিলেছে। এ রাজ্যে সব থেকে বেশি নোটা প্রয়োগ হয়েছে মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতেই। বস্তার এলাকায় চিত্রকোটের মতো ছোট কেন্দ্রেও ১০,৮৪৮ জন নোটায় ভোট দিয়েছেন। গোটা ছত্তীসগঢ়ে মোট ভোটের ৩.১৫ শতাংশ ভোট গিয়েছে নোটায়। এ রাজ্যে শতকরা প্রায় ১৭ ভাগ ক্ষেত্রে জয়ের ব্যবধানের চেয়ে বেশি ভোট পড়েছে নোটায়। মনে করা হচ্ছে মাওবাদী বা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ভোটাররাই এর কারণ।
ভাবাচ্ছে বিচ্ছিন্নতাকামীরাও। হুরিয়ত কনফারেন্স নোটাকে স্বাগত জানাতে শুরু করেছে। ফলে কাশ্মীরের কংগ্রেস নেতারা তো ইতিমধ্যেই তাঁদের রাজ্যে নোটাকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। চিন্তায় কেন্দ্রও।
নোটা নিয়ে পাল্টা মতও উঠে আসছে। কেউ কেউ বলছেন, নোটায় তেমন ধার নেই। কারণ, বাকি সব ভোট নোটায় গেলেও মাত্র ১টি ভোট পেয়েও কেউ বিধায়ক বা সাংসদ হতে পারেন। অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা তাই দাবি করছেন, “আইন বদলে একটি নির্দিষ্ট হার বেঁধে দেওয়া হোক, যার নীচে ভোট পড়লে গোটা কেন্দ্রেরই ভোট বাতিল হয়।” বাম সাংসদ ডি রাজার মতে, “ভোটাররা একটি মৌলিক অধিকার পেলেন। কিন্তু বিষয়টি অস্পষ্ট ও অপ্রাসঙ্গিক। এ বারের ভোটে এর প্রভাবও নেই।”
লালকৃষ্ণ আডবাণী আবার স্বাগতই জানিয়েছেন নোটাকে। তবে একে অর্থবহ করে তুলতে ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। নরেন্দ্র মোদী তাঁর রাজ্যে স্থানীয় স্তরের নির্বাচনে ভোটদান বাধ্যতামূলক করার বিল দু’-দু’বার পাশ করিয়েছেন। কিন্তু রাজ্যপালের অনুমোদন মেলেনি। আশিস নন্দী অবশ্য বলছেন, “নোটাকে আরও জনপ্রিয় করতে ২-৩টি নির্বাচন লেগে যাবে। পুরোদমে এর প্রয়োগ শুরু হলে নেতারা বুঝবেন, কত ধানে কত চাল। দলগুলি ভদ্রস্থ প্রার্থী দিতে বাধ্য হবে। রাজনীতিতেও স্বচ্ছতা আসবে।” |
|
|
|
|
|