প্রায় ১৭০০ ফুট উঁচু পাহাড়। পাহাড় চুড়োয় শাল-সেগুন-পিয়ালের জঙ্গল। তারই মাঝে ধাপে ধাপে সুন্দর করে সাজানো কটেজ। সকালে ঘুম ভাঙবে পাখির ডাক শুনে। কটেজ থেকে বাইরে বেরোলেই চোখে পড়বে হরেকরকম পাখি। শীতের সকালে হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ নিয়ে উপভোগ করুন চারপাশের নির্জনতা।
গড় পঞ্চকোটে আপনাকে স্বাগত!
একবার যাঁরা গেছেন পুরুলিয়ার নিতুড়িয়া ব্লকের ওই পাহাড়ে, তাঁরা বারবার যেতে চান। যাচ্ছেনও। এটাই গড় পঞ্চকোটের ‘ইউএসপি’। আর সেই ‘ইউএসপি’-র সৌজন্যেই উত্তরবঙ্গের লাভা, লোলেগাঁও, মংপং, রংপো, মূর্তি বা সামসিংকে পিছনে ফেলে ব্যবসার নিরিখে রাজ্যের প্রথম গড়পঞ্চকোট প্রকৃতি-ভ্রমণ কেন্দ্র। রাজ্য বন উন্নয়ন নিগমের জেনারেল ম্যানেজার (সদর) নীরজ সিঙ্ঘল বলেন, “রাজ্যে নিগমের যে ক’টি নেচার-রিসর্ট আছে, গত আর্থিক বছরে সেগুলির মধ্যে গড় পঞ্চাকোটই সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করেছে। ওই পর্যটন কেন্দ্রকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে নানা পদক্ষেপ করা হচ্ছে। ফি বছর পর্যটক সংখ্যাও বাড়ছে সেখানে।” |
পাহাড়তলির সুসজ্জিত অতিথি আবাস। সুজিত মাহাতোর তোলা ছবি। |
নিগমের খড়গপুরের ডিভিশনাল ম্যানেজার মিলন মণ্ডল বলেন, “সম্প্রতি নিগমের বাজেট মিটিংয়ে দেখা গেছে, রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করেছে এই পর্যটন কেন্দ্র। ২০১২-’১৩ আর্থিক বছরে ৬২ লক্ষ টাকার কাছাকাছি ব্যবসা হয়েছে গড় পঞ্চকোটে।” বস্তুত, উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি-ভ্রমণ কেন্দ্রগুলির মতো প্রচারের আলোয় না থেকেও শুরু থেকেই ধারাবাহিক ভাবে ভালো ব্যবসা করছে গড় পঞ্চকোট।
এই সাফল্যের রসায়ন কী?
নিগমের কর্তাদের মতে, এখানে যাঁরাই একবার এসেছেন, তারা ছুটি কাটানোর জন্য ফের বেছে নিয়েছেন পাহাড়ের কোলে এই শান্ত, মনোরম পর্যটন কেন্দ্রটিকে। মিলনবাবুর কথায়, “পরিসংখ্যান অনুযায়ী গড় পঞ্চকোটে আসা পর্যটকদের মধ্যে ৪০ শতাংশ নতুন। বাকি ৬০ শতাংশ পর্যটক একাধিকবার এখানে এসেছেন। ফলে অন্য প্রকৃতি-ভ্রমণ কেন্দ্রগুলিকে পিছনে ফেলতে সমর্থ হয়েছে পুরুলিয়ার এই কেন্দ্র।” বস্তুত, ছোট্ট ছুটি বা সপ্তাহান্তের ছুটি কাটানোর জন্য গড় পঞ্চকোট একেবারে আদর্শ। নিগমের এক অফিসার বলেন, “আসানসোল, বরাকর বা আদ্রা স্টেশনে নেমে সহজেই সড়কপথে আসা যায় এখানে। রাস্তাঘাটের অবস্থাও ভালো। স্থানীয় গ্রামের যুবকরা বন সুরক্ষা কমিটি গড়ে দক্ষতার সঙ্গে পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছেন পর্টকদের। পর্যটকদের বারবার এখানে আসার সেটাও অন্যতম কারণ।”
সবুজ ঘেরা এই পাহাড়েই একদা ছিল পঞ্চকোট রাজবংশের রাজধানী। ইতিহাসের হাতছানির পাশাপাশি এখানে আছে সুন্দর নিসর্গ। অদূরেই ঝাড়খণ্ড সীমানার পাঞ্চেত জলাধারের জলরাশি। সামান্য দূরেই ‘হীরক রাজার দেশে’-র শু্যটিংয়ের জন্য বিখ্যাত রঘুনাথপুরের জয়চণ্ডী পাহাড়। আর একটি আকর্ষণ হল রঘুনাথপুরের তসর সিল্ক, যার খ্যাতিও নেহাত কম নয়। সব মিলিয়ে ছুটির প্যাকেজ হিসাবে দুর্দান্ত।
পাহাড়ের কোলে এই প্রকৃতি-ভ্রমণ কেন্দ্রের ছ’টি কটেজে মোট ১৭টি ঘর রয়েছে। দামোদর, বরাকর, শাল, পিয়াল, মহুয়ার মতো কটেজগুলিতে স্বাচ্ছন্দ্য যথেষ্ট। এক সঙ্গে ৪২ জন থাকতে পারেন এই কটেজগুলিতে। বনসুরক্ষা কর্মীদের পাশাপাশি এখানে রয়েছেন নিগমের বিট অফিসার-সহ চার কর্মী। বিট অফিসার নিমাই মোহান্ত বলেন, “পুরুলিয়ার প্রচণ্ড গরমের দুই মাস বাদ দিয়ে বাকি সময়ে কোনও কটেজই ফাঁকা থাকছে না। যত দিন যাচ্ছে, পর্যটকদের চাহিদাও বাড়ছে।” মূলত কলকাতা এবং দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান জেলা থেকে পর্যটক আসেন পঞ্চকোটে। ধীরে ধীরে ভিন্ রাজ্যের পর্যটকেরাও আসা শুরু করেছেন এখানে। “সম্প্রতি দিল্লি থেকে এক চিকিত্সক এসে গড় পঞ্চকোটে সাত দিন ছিলেন। ফিরে তিনি তাঁর প্রবাসী ছেলেকেও এখানে ছুটি কাটানোর পরামর্শ দিয়েছেন। শুধু এই রাজ্যই নয় পঞ্চকোট এখন ভিন রাজ্যর ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম গন্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।” বলছিলেন নিগমের পুরুলিয়ার রেঞ্জ অফিসার লক্ষ্মীকান্ত মাহাতো।
ব্যবসার নিরিখে প্রথম হলেও একেবারে অভিযোগ-মুক্ত নয় এই প্রকৃতি-ভ্রমণ কেন্দ্র। যেগুলির অন্যতম আশপাশের দর্শনীয় এলাকা ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা এখনও নিগমের না-করে উঠতে পারা। একদা এখানে ভেষজ চিকিত্সার ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে সেটি বন্ধ। কিছু সমস্যা যে রয়েছে স্বীকার করে নিয়েছেন খড়গপুরের ডিভিশনাল ম্যানেজার মিলনবাবু। তিনি বলেন, “পাশের এলাকা ঘুরে দেখার জন্য স্থানীয় ভাবে গাড়ির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি, বাসের মাধ্যমে ‘সাইটসিয়িং’ করানোর। বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গড় পঞ্চকোটে স্পা খোলার পরিকল্পনাও রয়েছে।”
ব্যবসা বাড়াতে ইতিমধ্যেই সেখানে ৩০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নতুন কটেজ গড়ছে বন উন্নয়ন নিগম। মিলনবাবুর কথায়, “অনলাইন বুকিংয়ের ব্যবস্থা সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু হয়েছে। পর্যটকদের চাপ সামলাতে নতুন কটেজ নির্মাণ আগামী আর্থিক বছর থেকেই শুরু হবে।” |