কখনও হাতল ছেড়ে দ্রুত গতিতে মোটরবাইক চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আরোহী। কখনও আবার বাইক কাত করে রাস্তার সঙ্গে ঘর্ষণে ছোটানো হচ্ছে আগুন। গা ঘেঁষে চালিয়ে চমকে দেওয়া হচ্ছে পথচারীদের।
সন্ধ্যা নামলেই শিল্পাঞ্চলের নানা এলাকায় বিকট শব্দ করে মোটরবাইক চালিয়ে নিয়ে যাওয়া এক দল তরুণের দৌরাত্ম্যে তটস্থ পথচারীরা। চোখের পলক পড়ার আগে দ্রুত গতিতে পালানো ওই মোটরবাইক আরোহীদের পিছু ধাওয়া করতে হিমসিম পুলিশও। শুধু দ্রুত গতি নয়, চলন্ত মোটরবাইক থেকে নানা রকম কেরামতিও দেখাতে থাকে তারা। ফলে, মাঝে-মধ্যেই ঘটছে দুর্ঘটনা। |
সন্ধ্যা নামলেই আসানসোলের রবীন্দ্রভবন চত্বর, এসবি গড়াই রোড, বার্নপুরের ব্যাঙ্ক রোড, এডিএম বাংলোর সামনের রাস্তা, আসানসোলের রেল অফিসার্স ক্লাব রোড, কুলটি ক্লাব রোড, থানা রোড ইত্যাদি এলাকায় দেখা মেলে এই বাইক আরোহীদের। এক একটি মোটরবাইকে সওয়ার একাধিক তরুণ। তীব্র গতিতে ছুটে যায় পাঁচ-সাতটি বাইকের একটি দল। সঙ্গে নানা রকম কায়দা ও বিকট আওয়াজ। দেখা যায়, মোটরবাইকের পিছন থেকে আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে। পথচারীরা জানান, লক্ষ করে দেখা গিয়েছে, মোটরবাইকের স্ট্যান্ডের সঙ্গে লাগানো রয়েছে দু’টি লোহার দণ্ড। দ্রুত গতিতে মোটরবাইক ছোটানোর সময়ে পিছনে বসে থাকা আরোহী পা দিয়ে লোহার দণ্ডটি রাস্তার সঙ্গে ঠেকিয়ে রাখে। এর ফলে প্রবল ঘর্ষণে আগুন ঠিকরে বেরোয়। রাস্তায় বাঁকের মুখে তারা একেবারে কাত করে দেয় মোটরবাইক। মাঝে-মধ্যে হাতল ছেড়ে, কখনও আবার চলন্ত বাইকে দাঁড়িয়েও নানা রকম কায়দা দেখাতে থাকে ওই তরুণেরা।
পথচারীরা জানান, ওই তরুণদের দেখলেই বোঝা যায়, পস্পরের সঙ্গে বাজি ধরে শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটছে তারা। নিজেদের জীবনের বাজি যেমন ধরছে, তেমনই সাধারণ পথচারিদের বিপদের মধ্যে ফেলছে তারা। আসানসোলের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা নিবেদিতা আচার্য বলেন, “দূর থেকে মোটরবাইকের শব্দ ভেসে আসতেই বুক কাঁপতে শুরু করে। এই বুঝি টাল সামলাতে না পেরে গায়ের উপরে এসে পড়ল।” সন্ধ্যায় অনেক বেশি ব্যস্ত থাকে এস বি গড়াই রোড। তাতেও কোনও পরোয়া নেই ওই বাইক আরোহীদের। স্থানীয় বাসিন্দা শিবানি মালখন্ডি জানান, দিন কয়েক আগেই ওই বাইক আরোহীদের দাপটের জেরে একটি দুর্ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন। তিনি বলেন, “এই অল্পবয়সী বাইক চালকদের দৌরাত্ম্যে ঘর থেকে বেরনো বন্ধ হওয়ার জোগাড়।” প্রাক্তন কলেজ অধ্যক্ষ অরুণাভ দাশগুপ্তের কথায়, “কখন দুর্ঘটনা ঘটে, সেই আতঙ্কে বিকেলে রবীন্দ্রভনের সামনে ঘুরতে যাওয়ার আর ভরসা পাচ্ছি না।”
এক দল অল্পবয়সীর এই দৌরাত্ম্যের কথা জানে পুলিশও। থানাতেও বহু অভিযোগ জমা হয়েছে বলে জানিয়েছেন এডিসিপি (ট্রাফিক) সুরেশকুমার চাডিভে। মাস তিনেক আগে পদে যোগ দেওয়ার পরে নতুন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলও এ ধরনের মোটরবাইক চালকদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করার কথা জানান। এডিসিপি (ট্রাফিক) সুরেশকুমার চাডিভে বলেন, “রাস্তায় স্পিড ব্রেকার দেওয়া হয়েছে। যে সব রাস্তায় তাদের দৌরাত্ম্য চলছে সেখানে রাস্তার মাঝে অস্থায়ী লোহার বেড়া দিয়েছি। পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে।” এক পুলিশকর্তা জানান, ওই মোটরবাইক আরোহীদের সবার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না, কারণ তারা ছাত্র। তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই কঠিন শাস্তি দেওয়া যাচ্ছে না।
কেন কমবয়সী এই ছেলেরা ঝুঁকি নিয়ে মোটরবাইক চালাচ্ছে? মনোবিদ বিশেষজ্ঞ নন্দকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “আসলে এই বয়সের ছেলেমেয়েরা গতি পছন্দ করে। এ সবে যে বিপদ ঘনাতে পারে, তা বুঝতে পারে না। তারা প্রচুর জীবনিশক্তিকে খরচ করার মাধ্যম খোঁজে। তাই এই ধরনের পন্থা অনেকে বেছে নিয়েছে।” তিনি জানান, এর থেকে বিরত করতে হলে তাদের কাউন্সেলিং করতে হবে। সেটা পরিবার বা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মাধ্যমে করাতে হবে। সমাজসেবী বিজন বিশ্বাসের আবার বক্তব্য, “এই মোটরবাইক কিনে দিচ্ছেন পরিবারের লোকেরাই। তাই সন্তানরা যেন এই সর্বনাশা খেলায় না মাতে, সেটা ঠিক করতে হবে পরিবারের লোকেদেরই।” |