বাড়িতে পার্টি করলে সবচেয়ে জোর দিন খাবারে
জকাল একই দিনে অনেকগুলো পার্টি হওয়াতে লোকজন বুঝেই উঠতে পারে না কোন পার্টিটায় সময় কাটাবে। একটা পার্টিতে চার-পাঁচ মিনিটের বেশি কাটানো সম্ভবই নয় কারও পক্ষে। তবে স্টার অ্যাট্রাকশন যেহেতু একটা পার্টিই হয়, তাই অন্যান্য পার্টিগুলো ঠিক যেন মেনকোর্সের আগে স্টার্টার।
সৌভাগ্যবশত আমাদের বাড়িতে যে পার্টিগুলো এত বছর ধরে করে আসছি, সেখানে লোকজন আসে নতুন নতুন লোকের সঙ্গে মোলাকাত করতে, পুরনো বন্ধুত্বগুলো ঝালিয়ে নিতে। খেলার জগতের নামজাদা ব্যক্তিত্ব, শিল্পীদের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগটাও সবাই পায় এখানে। তা ছাড়া ঘরোয়া সুস্বাদু খাবার, ড্রিঙ্কস আর মন কেমন করা সব সুরের তালে তালে নাচের সুযোগটা তো উপরি পাওনা।
কোনও খ্যাতনামা ক্রিকেটারকেই এখন আর বিনা কারণে কোনও পার্টিতে আসতে দেখা যায় না।
বেশ কিছু ক্ষমতাবান লোক নিজেদের বাড়ির পার্টির গ্ল্যামার বাড়াবেন বলে নেমন্তন্ন করেন ক্রিকেটারদের। আর তাদের চারপাশে লেগে থাকে পাপারাৎজির ভিড়।
তবে এমনও দিন ছিল, যখন সেলিব্রিটি ক্রিকেটাররা দিনের বেলায় খেলতেন আর সন্ধেবেলা মন খুলে পার্টি করতেন। আমাদের লাউডন স্ট্রিটের বাড়িতে এমনই এক পার্টিতে নেমন্তন্ন করেছিলাম পাকিস্তানি ক্রিকেটার জাহির আব্বাস, ইমরান খান, মুদস্সর নজর, জাভেদ মিয়াঁদাদ ছাড়াও চিস্তি মুজাহিদ, ইফতিকার আমেদের মতো কমেন্টেটরদের।
যখন ওঁদের নেমন্তন্ন করি, সেই সময় আমাদের রান্নাঘরের হাল বেশ খারাপ। আমাদের প্রধান রাঁধিয়ে ছিলেন ছুটিতে। আমরা তো ভেবেই অস্থির আমাদের সেলিব্রিটি অতিথিদের কী খাওয়াব ভেবে! এই পাকিস্তানিরা নিজেদের দেশে অসাধারণ অতিথি আপ্যায়ন করতেন ওঁদের ‘মেহমান নওয়াজি’ যাকে বলে লেজেন্ডারি। কাজেই ওঁদের খাওয়ানো নিয়ে ভাবনা হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। সে যাত্রা উত্তর কলকাতার নামজাদা রেস্তোরাঁ ‘রয়্যাল’ উতরে দিয়েছিল আমাদের। মেনকোর্সে রেখেছিলাম ‘রয়্যাল’য়ের বিরিয়ানি আর চাঁপ। সঙ্গে ঘরে বানানো রায়তা। নিমন্ত্রিতরা সে খানা খেয়ে একেবারে কুপোকাত। বিশেষ করে বিরিয়ানিটা দারুণ মনে ধরেছিল ওঁদের। ইমরানকে খাইয়ে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। দুর্ধর্ষ ‘খাইয়ে’ ছিলেন ইমরান।
ওই পার্টিতে যে ক’জন দম্পতি বা মহিলাকে নেমন্তন্ন করেছিলাম, তাঁদের ক্রিকেট সম্পর্কে জ্ঞানগম্যি আছে ভেবেই বলা হয়েছিল তাঁদের। একজন এসেছিলেন, ক্রিকেট নিয়ে যাঁর তেমন কোনও মাথাব্যথা ছিল না। তাঁর সেই ক্ষুদ্র জ্ঞান প্রয়োগ করে তিনি ইমরানকে জিজ্ঞেস করে বসেন ইমরান ব্যাট করেন না বল করেন। ইমরান শুনে বেশ মজা পেয়েছিলেন। অন্তত মহিলাদের ছোড়া ‘দক্ষ’ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি, এই ভেবে।
২০০২-য়ে কোচ হিসেবে মুদস্সরের একটা ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে ঢাকায় দেখা হয়েছিল ওঁর সঙ্গে। ওঁকে খবর দিয়েছিলাম একটা দারুণ বিরিয়ানির। ঢাকার ব্যস্ত অফিস চত্বর কামরান বাজারে বেলা ১টা-২টোর মধ্যে লাঞ্চটাইমে সেই স্বর্গীয় স্বাদের বিরিয়ানি মেলে। ডেকচি থেকে পিড়ি করে সেই বিরিয়ানি পরিবেশন করা হয়। ওঁকে সে কথা জানাতে উনি বলেন আশির দশকে আপনার বাড়িতে গিয়ে যে বিরিয়ানিটা খেয়েছিলাম, এই বিরিয়ানির স্বাদও কি সে রকম হবে?
পাকিস্তানিদের আপ্যায়ন কৌশলটা সত্যিই অভূতপূর্ব। সমস্যা খালি এক জায়গাতেই। ওঁদের খাবারের তালিকায় ভেজিটেরিয়ান খাবার যেন অচ্ছ্যুৎ! আমার হাজব্যান্ড রুটির সঙ্গে খাওয়ার জন্য সাধারণ ভাবে রান্না ডাল চেয়েছিলেন। তা জানতে পেরে ওরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। বলেছিল রুগির পথ্য কী করে খেতে দেবে ওঁকে!
একটা পার্টির কথা না বললেই নয়। এই পার্টিটা দেওয়া হয়েছিল এক খুব পরিচিত লেখিকার উদ্দেশে। আমাদের চেনা এক ভদ্রমহিলা এই সব কেতাদুরস্ত ব্যাপার খুব পছন্দ করেন। তিনি আবার ওই লেখিকার বেশ বড় ফ্যান-ও। আমাদের ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন আমরা তাঁকে ওই পার্টিতে নিয়ে যেতে পারি কি না। আমরা তাঁর অনুরোধ ফেলতে পারিনি। ওখানে পৌঁছে আশ্চর্য হলাম দেখে যে তিনি জানতেনই না লেখিকা কোন জন। ফলে তিনি আর এক মহিলা লেখিকাকে দেখার জন্য লম্বা লাইন লাগান আর সেই মহিলার উচ্চকিত প্রশংসা করতে থাকেন। বেশ হাস্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল সে দিন। আমরা অসম্ভব বিব্রত হয়েছিলাম এই ঘটনায়। লেখিকা যখন এই ঘটনাটি জানতে পারেন, তখন বেশ মজাচ্ছলেই বলেন: “খুব ইন্টারেস্টিং চরিত্র! আমার পরের উপন্যাসে তো রাখতেই হবে এর কথা।”
যে সময়ের কথা এখন বলব, তখন খুব লোডশেডিং হত। এমনই এক দিনে আমরা একটা পার্টি অ্যারেঞ্জ করেছিলাম। সন্ধে সাতটায় লোডশেডিং! প্রচণ্ড হতাশ হয়ে শেষমেশ আমাদের এক প্রতিবেশীর বাড়িতে খাবার, গ্লাস, প্লেট সব নিয়ে হাজির হয়েছিলাম। সেখানেও ৮.৩০-য়ে লোডশেডিং হয়ে যায়। আর ইনভার্টারের ব্যবস্থাও ছিল না। কাজেই সন্ধের বেশি সময়টা জুড়ে মোমবাতির আলোয় পার্টি চলেছিল। আর সেখানে লোকজন কী ভাবে নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতা চালাচ্ছিলেন, তা বোধহয় আর না বললেও চলে!
এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পার্টিটা হয়েছিল পাবলিক রিলেশনের উপর আমার একটা বই লঞ্চ করার সময়। ঠিক আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন বলতে যা বোঝায়, পার্টিটা তেমন কিছু ছিল না। বেশ একটা ঘরোয়া পার্টিই হয়েছিল। আমাদের ড্রাইভারকে পাঠিয়েছিলাম অতিথিদের নেমন্তন্নের কার্ড দিতে। নিমন্ত্রিতদের একজন ছিলেন এক অল্পবয়সি মহিলা যাঁর প্রথম নাম এক নামকরা পেজ থ্রি বাঙালি অভিনেত্রীর নামে। আমাদের ড্রাইভার, বেশ মুগ্ধ হয়েই কার্ড আর একবাক্স চকোলেট ওই অভিনেত্রীর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসে। ওঁর স্বামী পেন্সিলে লিখে পাঠিয়েছিলেন তিনি চকোলেট খেয়েছিলেন, তবে অনুষ্ঠানের দিনে সম্ভবত তাঁরা বাইরে থাকবেন। সাঙ্ঘাতিক! আমরা নতুন করে নেমন্তন্নের কার্ড পাঠিয়েছিলাম ওই বন্ধুকে। তবে এ বার চকোলেট বক্স বাদ দিয়ে!
কেটারাররাও ঘটনাবিশেষে ভুল করেন না তা নয়। ক্রিকেটের একটা বিশেষ ইভেন্ট উপলক্ষে আমাদের বাড়ির এক ককটেল পার্টিতে দেখেছিলাম আমাদের পছন্দের বিশেষ স্ন্যাক্সগুলো বিল্ডিংয়ের অন্য ব্লকে পাচার হয়ে যেতে। বাড়ির মালিকরা সেই সময় ছিলেন না। ওঁদের কাজের লোকেরা ভেবেছিল ওটা বোধহয় কোনও রকম সারপ্রাইজ। তাই ডেলিভারি সই করার সময়ও তারা কিছু ভেবে দেখেনি। সে দিনের সন্ধেটা ক্রিকেট নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্য দিয়েই কেটেছিল। তাই পরে আর এগুলো আলোচনা করার বিষয়টা মাথায় ছিল না।
ঘরোয়া পার্টিগুলো সত্যিই অতুলনীয়। সেই দিনগুলোয় ড্রিঙ্কস, ডিনার, সঙ্গে হাল্কা মিউজিক চালিয়ে, অল্প আলোয় বুঁদ হয়ে নাচ। পার্টিতে প্রচুর কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে নানান বিষয়ে তুমুল তর্কবিতর্কও চলত। তবে হ্যাঁ, কোনও পোজ দেওয়ার ব্যাপার ছিল না। একটা পার্টির কথা বলে শেষ করব লেখাটা। আইটিসি-র দেবেশ্বর একটা বিশাল মাপের পার্টি করেন প্রতি বছর। বেশ সেজেগুজে অতিথিরা যান সেই পার্টিতে। ভারতের সব প্রদেশের জিভে জল আনা সব খাবারের এলাহি বন্দোবস্ত থাকে সেখানে। এমনকী খাবার তালিকায় বাদ যায় না ইতালি, জাপান থেকে শুরু করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও। সবাই টেবিলের চারধারে গোল হয়ে বসে খাবার খায়, আড্ডা মারে। আর হ্যাঁ, সেই ছবি তোলার জন্য আশেপাশে ফোটোগ্রাফারদেরও ঘুরঘুর করতে দেখা যায় না সেখানে।
শেষ করি চলুন ঘরোয়া পার্টি দিয়েই। বাড়িতে যখন কাউকে নেমন্তন্ন করেন, তখন খাবারটাই আসল। আর সেই খাবার যদি নিজের হাতে রাঁধা হয়, তা হলে তো লা-জবাব! আলাপচারিতা, চেনা-পরিচিতি সবটাই বাদবাকি অংশ আর কী। তাই বাড়িতে পার্টি করলে আপনার সেরা জিনিসটাই দেওয়ার চেষ্টা করুন আপনার অতিথিদের। আমার এক বন্ধু, মিসেস শ্রীনিবাসন তাঁর দক্ষিণ ভারতীয় পরিচয়ে এতটাই গর্বিত যে তাঁর দেওয়া পার্টিতে দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের প্রচুর ডিশ থাকবেই। আর ওঁর তুমুল মাংসভক্ত বাঙালি বন্ধুরা সেই খাবার চেটেপুটে খায়। কারণ প্রত্যেকটা খাবারই বাড়িতে রাঁধা। আর এর সঙ্গে বোধহয় আর একটা অনুচ্চারিত কথাও থেকে যায় যে দেখো, এই খাবারই আমার ঐতিহ্য, আমার ঘরানা। আমি চাই তোমরা একে ভালবাসো!
অন্য প্রদেশ থেকে আসা আমার বন্ধুদের জন্য আমি প্রায়ই ডাব-চিংড়ি পদটা রান্না করি। আর ওরা চেটেপুটে খায় সেই রান্না। আর খেতে খেতে ওটা কী ভাবে রেঁধেছি, তা নিয়ে কত প্রশ্নই না জিজ্ঞেস করে! তবে হ্যাঁ, আমি একটা নিরামিষ ডাব-ঝিঙের পদও রাঁধি। আমার মাছখোর বন্ধুরা সেটাও খুব ভালবেসে খায়।
শেষ পাতে বাইরে থেকে আনা মিষ্টির বদলে আমি দিই বাড়িতে তৈরি ভাপা দই। ওপরে ছড়িয়ে দিই কিশমিশ আর আধভাঙা কাজু। আর এই ডেজার্টটাও সাঙ্ঘাতিক হিট।
আর আত্মতুষ্টিটা কোথায় জানেন? আপনি বলতে পারবেন সবাইকে যে, ওটা আপনার নিজের হাতে রাঁধা। অতিথিদের থেকে পাওয়া প্রশংসার চেয়ে বড় পাওনা আর কিছু হয় না কি?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.