|
|
|
|
জানা বারণ |
বলা বারণ যত না, তার চেয়েও বেশি যেন জানতে চাওয়ার অনাগ্রহ। মহিলারাই যে জানতে চান
না শ্লীলতাহানি জনিত পরিস্থিতিতে তাঁদের অধিকারের কথা। খোঁজ নিলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত। |
গোয়ার চলচ্চিত্র উৎসবে এক পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ অদ্ভুত তথ্য তুলে ধরলেন তিনি।
বললেন, বলিউডের অনেক প্রযোজক দু’বার ভাবছেন অফিসে মহিলাদের কাজে নেওয়ার আগে।
কারণ একটাই। “তরুণ তেজপালের কেস নিয়ে এত জলঘোলা হওয়ার পরে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা বেশ তটস্থ হয়ে গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই মহিলাদের নিয়োগ করার আগে দু’বার ভাবছেন। শুধু শুধু কেউ কোনও ঝুটঝামেলায় যেতে চান না। যার বদমায়েশি করার, সে কি আর শুধু অফিসে বসেই সেটা করতে পারে নাকি? আমাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল যে কিছু বছর পরে দেখবেন ধীরে ধীরে একটা জেন্ডার বায়াস তৈরি হয়ে যাবে। এটা অফিশিয়ালি কেউ কিছু বলবে না। অনেকটা ওই হিন্দু পাড়ায় মাইনরিটির কাউকে ভাড়া না দেওয়ার মতো হয়ে দাঁড়াবে। আসল কারণটা সব্বাই জানেন, কিন্তু প্রকাশ্যে অন্য কারণ দেখানো হবে,” বললেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই পরিচালক। |
|
এই প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা এক মন্তব্য করে জোর বিতর্ক স্ৃষ্টি করেন। সংসদে ঢোকার আগে তিনি বলেছিলেন, “আমি মহিলাদের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পাই। ইনফ্যাক্ট, আমি কোনও মহিলাকে আমার সেক্রেটারি হিসেবেও রাখতে চাইব না। ঈশ্বর না করুন, যদি কেউ আমার নামে অভিযোগ করে, আমায় তো জেলে যেতে হবে। দেশের অবস্থা এমনই। আমি মানছি ধর্ষণের মতো ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে... তবু কোথাও এর একটা শেষ হওয়া দরকার। আমি মেয়েদের দোষ দিচ্ছি না। আমি সমাজকেই দায়ী করছি।”
বিতর্কের জেরে ফারুক অবশ্য পরে নিজের এই মন্তব্যের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্যের রেশ থেকেই যায়।
বহু চাকুরে মহিলা আজ এই প্রশ্নটাও করছেন যে, সত্যি কি তা হলে এ সবের জন্য মেয়েদের উপকার হবে?
নাকি এ সব করে অলিখিত কিছু বাধা তৈরি হয়ে যাবে কর্মক্ষেত্রে? বিভেদটা আরও বেড়েই চলবে? |
ভেদাভেদ বারণ |
পরিচালক সুধীর মিশ্র অফিসে যৌন হয়রানি সম্পর্কে চিত্রাঙ্গদা সিংহ ও অর্জুন রামপালকে নিয়ে বানিয়েছিলেন ‘ইনকার’। “আমার মনে হয় না যে এই সব ঘটনার ফলে অফিসে মহিলাদের নিয়ে ভেদাভেদ করা হবে। বলিউডে যাদের মধ্যে গণ্ডগোল রয়েছে, তারাই এ সব নিয়ে ভয় পাবে,” বলেন সুধীর।
এটাও জানান যে, অনেকে ওঁর ওপর রেগে গিয়েছিলেন সিনেমাটা বানানোর পরে। “বলেছিল এই সব অফিসে মহিলাদের এই রকম হয়রানি হয় না। কিন্তু এখন যা ঘটছে তা দেখে তাঁরা বুঝবেন যে, সত্যিটা কী। আমি পুরুষ ও মহিলা দু’তরফের সমস্যাই তুলে ধরেছিলাম। আমি তো আমার প্রযোজককে আবার করে ‘ইনকার’ রিলিজ করতে অনুরোধ করেছি,” বলছেন সুধীর। প্রয়োজনে এ বিষয়ে আবার একটা সিনেমা বানাতেও তিনি রাজি। ‘ইনকার ২’ বানানোর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তিনি। বললেন, “সুযোগ পেলে সিক্যুয়েল তো নিশ্চয়ই বানাব। পুরুষদের বুঝতে হবে যে, কোনও পর্যায়ে একজন মহিলা যদি ‘না’ বলেন, তার মানে কিন্তু ‘হ্যাঁ’ নয়।”
এ তো গেল সিনেমার কথা। কিন্তু বাস্তব জীবনের ছবিটা কেমন?
কিরণ বেদীর মতে, তেজপাল বিতর্কের রেশে পুরুষ এবং মহিলা দু’পক্ষই সতর্ক হবেন। “দু’পক্ষই এক্সট্রা কেয়ার নেবেন। মহিলারা আরও বেশি সিলেকটিভ হবেন কোথায় কাজ করবেন তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে। পুরুষরাও দেখে নেবেন কাদের নিয়োগ করা হচ্ছে। এই সচেতনতায় দু’তরফেই সুবিধা হবে,” বলছিলেন কিরণ।
স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার চেয়ারপার্সন অরুন্ধতী ভট্টাচার্য। বলছেন, “পাবলিক সেক্টরে রিক্রুটমেন্ট নিয়ে কোনও অসুবিধা হবে না, এটুকু আমি বলতে পারি।”
তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে? সেখানে কি এই অসুবিধা হতে পারে?
গ্রিনপ্লাই কোম্পানির হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টের জেনারেল ম্যানেজার গৌরব বারিকের মতে, প্রোগ্রেসিভ অর্গানাইজেশনগুলো এই রকম একটা অলিখিত নিয়ম করার চেষ্টা করবে না। “একমাত্র যাঁদের মনে একটা ভয় রয়েছে, তাঁরাই হয়তো এই ডিসক্রিমিনেশন করতে পারে। না হলে এটা হওয়ার চান্স খুব কম। আমাদের কোম্পানিতে তো কিছু ডিপার্টমেন্টে আমরা উৎসাহ দিই মহিলাদের রিক্রুট করার ব্যাপারে। কোয়ালিটি কাজ যদি করতে হয়, সেখানে এই সব যুক্তি কোনও দিন টিকবে না। উই হ্যাভ পলিসিজ ইন প্লেস,” বলছেন গৌরব। |
জানেন কি |
তরুণ তেজপাল আর জাস্টিস অশোক গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে দু’টো বিতর্কিত যৌন হয়রানির অভিযোগ শিরোনামে আসার পরে জনসাধারণের কাছেও দু’টো শব্দ বেশ প্রচলিত হয়ে গিয়েছে। তা হল বিশাখা গাইডলাইনস।
কোর্টের করিডরে যাঁদের যাতায়াত রয়েছে, তাঁদের বিশাখা গাইডলাইনস সম্পর্কে একটা ধারণা রয়েছে ঠিকই। কিন্তু যে কর্মরত মহিলাদের জন্য তা তৈরি, তাঁরা কতটা ওয়াকিবহাল এই গাইডলাইনস-য়ের ব্যাপারে? কত জন জানেন ভাঁওরি দেবীর কথা? যাঁকে শিশু বিবাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার ‘অপরাধ’য়ে কী ভাবে বারবার রাজস্থানে ধর্ষণ করা হয়েছিল! কিন্তু ধর্ষণকারীদের কোনও শাস্তি মেলেনি যত ক্ষণ না ‘বিশাখা’ নামে এক নারী সংগঠন এই নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন দাখিল করে।
সেটা ছিল ১৯৯৭-য়ের ঘটনা। এর মধ্যে ভাঁওরি দেবীকে নিয়ে নন্দিতা দাস ‘ভওন্দর’ নামে একটি সিনেমা করেছিলেন। গত বছর এই একই বিষয়ে আরও একটি ছবি করার কথা ছিল মল্লিকা শেরাওয়াতের। ছবিটা হয়েছিল, কিন্তু মল্লিকা তাতে অভিনয় করেননি।
চলচ্চিত্র জগতের সে সব খবর নিয়ে অনেকেই চর্চা করেছিলেন। কিন্তু বিশাখা গাইডলাইনস? জিজ্ঞেস করলে তাঁরা বলেন: তা খায়, না মাথায় দেয়?
পাঁচ বছর হল একটা নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানিতে চাকরি করছেন রাজর্ষি দাশ। তিনি জানেন যে প্রত্যেক নিয়োগকর্তার উচিত একটা অভ্যন্তরীণ অভিযোগ জ্ঞাপন কমিটি তৈরি করা। তবে এর বেশি কিছু তাঁর জানা নেই। জানা নেই যে প্রত্যেকটি অফিসে (যেখানে দশ জনের বেশি লোক কাজ করে) যে কমপ্লেন্ট কমিটিটা থাকবে, তার শীর্ষে থাকতে হবে এক মহিলাকেই। কমিটির অর্ধেক সদস্যও হতে হবে মহিলা। ভাঁওরি দেবীর কথা শুনেছেন রাজর্ষি। জানেন তা নিয়ে ছবি হয়েছে। কিন্তু বিশাখা গাইডলাইনস? “নো, জানি না। এই প্রথম শুনলাম প্রত্যেকটা কর্মক্ষেত্রে এই কমিটির সদস্যদের নাম ডিসপ্লে করাটা জরুরি। আমরা জানি যে আমাদের অফিসের হিউম্যান রিসোর্স বিভাগে এমন একজন আছেন যাঁর কাছে কোনও ঝামেলা হলেই অভিযোগ জানানো যায়,” বলছেন রাজর্ষি। |
|
‘ইনকার’য়ে অর্জুন রামপাল ও চিত্রাঙ্গদা সিংহ। |
একই অবস্থা শাঁওলি চট্টোপাধ্যায়ের। সেক্টর ফাইভের এক বিপিও-তে চাকরি করছেন তিন বছর। “অফিসে সুরক্ষা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। তবে ওই সব আইনকানুনের খুঁটিনাটি সম্পর্কে কিছুই জানি না,” স্বীকারোক্তি শাঁওলির।
অনেক অফিসেই এই গাইডলাইনস অনুসারে কমিটি তৈরি করা রয়েছে। তবে মহিলা কর্মীরা সে সম্পর্কে একদম উদাসীন। হয়তো অফিসের দেওয়ালে পোস্টার লাগানো রয়েছে। কিন্তু তা অফিস পার্টির আমন্ত্রণ, না তাঁদের সুরক্ষার চেক লিস্ট এ নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। সারাক্ষণ হোয়াটস্অ্যাপ করছেন। একটা ক্লিক করলেই যে ইন্টারনেটে সব কিছু জানা যেতে পারে, তা নিয়ে সাঙঘাতিক অনীহা।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর বিশাখা ঘোষ। নিজে একটা ওয়েবসাইটে গিয়ে এটা নিয়ে পড়াশুনো করেছেন। “তবে আজ অবধি কোনও স্কুল বা কলেজের নোটিস বোর্ডে আমি এই বিষয় নিয়ে কোনও পোস্টার দেখিনি। খুব কম মহিলাই এ বিষয়ে সচেতন। তাঁরা জানেনও না। জানতে চানও না। এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতেও তাঁদের ভয় থাকে। ‘স্টেটাস কুয়ো মেন্টেন’ করতে চান তাঁরা,” বলছেন বিশাখা।
হেডলাইনস টুডে-র অ্যাসোসিয়েট সিনিয়র প্রোডিউসর বিপাশা মুখোপাধ্যায় অফিসে গ্রাফিক্স বানানোর সময় অনলাইনে বিশাখা গাইডলাইনস নিয়ে পড়েছিলেন। আজকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে সব আইনগুলো গড়গড় করে বলে যেতে পারবেন? জিভ কেটে বলেন, “পারব না। আসলে মোবাইলে নেট থাকার কুফল এটা। জানি, দরকার হলে সার্ফ করে নেব। তাই আগে থেকে জেনে রাখার চেষ্টাটাই চলে গিয়েছে।”
এই অনীহার কারণ কি শুধুই প্রযুক্তির উন্নয়ন?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রধান রুবি সেন বলছেন যে এই সবের মূলে রয়েছে এ বিষয়ে পড়াশুনো বা চর্চার অভাব। ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের স্কুল বা কলেজে এ নিয়ে পড়ানো হয় না। কর্মক্ষেত্রেও যে এই নিয়ে খুব সাঙ্ঘাতিক সচেতনতা তৈরি করা হয়, তা নয়। বাবা-মা এ নিয়ে কথা বলেন না। স্বামীরাও এ প্রসঙ্গ বাড়িতে তোলেন না। “তাই সেই কালচারটাই তৈরি হয় না যেখান থেকে এই ধরনের কিছু নিয়ে জানার চেষ্টাকে উৎসাহ জোগানো হয়। তার পর অনেকের মধ্যে এই মানসিকতাটাও থাকে যে, যত ক্ষণ না নিজের ক্ষেত্রে এ রকম কিছু ঘটছে, তত ক্ষণ তা নিয়ে চর্চা করার দরকার নেই,” বলছেন রুবি।
|
আমার প্রযোজকদের অনুরোধ করেছি ‘ইনকার’ ছবিটি রি-রিলিজ করতে। এর সিক্যুয়েল বানাতেও আমি আগ্রহী
সুধীর মিশ্র |
বেঙ্গালুরুর এক কোম্পানিতে বিশাখা গাইডলাইনস নিয়ে পরীক্ষায় পাস না
করলে চাকরি দেওয়া হয় না
কিরণ বেদী |
|
অফিস কথা |
অভিজিৎ ভট্টাচার্য ইউনাইটেড স্পিরিটস-য়ের এইচআর ডিপার্টমেন্টের জেনারেল ম্যানেজার। বলছেন, “আমার মনে হয় ঝামেলাটা তখনই শুরু হয়, যখন একজন কলিগ আরেক জনকে কলিগ হিসেবে না দেখে তাঁর লিঙ্গ অনুযায়ী তাঁকে আলাদা করে দেখতে শুরু করেন। আমাদের অফিসে নিয়মগুলো খুবই কঠোর। এখানে মহিলাদের সম্মান করা হয়। আমরা মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন। বিশাখা গাইডলাইনস অনুযায়ী যে রকম কমিটি থাকা দরকার, তা তৈরি করার কথা আমরা ইতিমধ্যেই ভাবতে শুরু করে দিয়েছি।”
আশিস রঞ্জন জয়সোয়াল চাকরি করেন স্যামসাং কোম্পানিতে। সেখানে তিনি রিজিওনাল এইচআর দফতরের ম্যানেজার (ইস্ট)। বলছেন, “যৌন হয়রানি হলে সেটাকে সিরিয়াসলি দেখি। প্রথম থেকেই আমাদের অফিসে কোড অব কনডাক্ট ঠিক করে দেওয়া হয়। বিশাখা গাইডলাইনসে যা বলে দেওয়া হয়েছে, তা আমাদের এই কোডেই বলা আছে।”
তবে শেষ কথা বলছেন কিরণ বেদী। সম্প্রতি বেঙ্গালুরুর এক সফ্টওয়্যার কোম্পানির কর্ণধারের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। বলছেন, “কোম্পানিটির নাম ‘এসইটি’। তার সিইও জানালেন যে তাঁদের অফিসে বিশাখা গাইডলাইনসের ওপর একটা বাধ্যতামূলক অনলাইন কোর্স আছে, যেটা প্রত্যেক কর্মচারীকে পাশ করতে হয়। তবেই তাঁকে রিক্রুট করা হয়। পাশ করার পর কেউ বলতে পারে না সে আইন সম্পর্কে অজ্ঞ। এই পদ্ধতি সব অফিসেই অনুসরণ করা দরকার। শুধু আইন থেকে তো লাভ নেই যদি না মানুষ সে সম্পর্কে অবহিত থাকেন।”
কিরণের উপদেশ সবাইশুনছেন কি?
|
কখন অভিযোগ করবেন |
• শুধুমাত্র অনিচ্ছাকৃত শরীরী সংস্পর্শ মানেই যৌন হয়রানি নয়
• চটুল জোকস্, ইঙ্গিতপূর্ণ মৌখিক দুর্ব্যবহারও যৌন হয়রানির মাপকাঠিতেই পড়ে
• অশালীন গসিপ করাটাও অপরাধযোগ্য
• ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই তা রিপোর্ট করা দরকার
• তবে যেহেতু একজন সহকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে সাহসের প্রয়োজন, তাই আক্রান্ত মহিলা ঘটনা ঘটার অনেক পরেও অভিযোগ জানাতে পারেন |
|
সূত্র: অরুণাভ ঘোষ, আইনজীবী |
|
|
|
|
|