|
|
|
|
বসিরহাট টু আইসল্যান্ড, ভায়া চ্যাট রুম |
আইডিয়া চমকপ্রদ। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেল অন্য জায়গায়। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়। |
রুমাল যদি বেড়াল হতে পারে, শুঁয়োপোকা যদি প্রজাপতি হতে পারে, তা হলে স্বর্ণকমলপুরের আলাভোলা অঙ্কের মাস্টার আইসল্যান্ড যেতে পারে না কেন?
পারে বই কি!
অঞ্জনিপুত্র সেনশর্মাও পেরেছিল। বউকে লিখে গিয়েছিল, আমি যাচ্ছি। যে লোক কোনও দিন বসিরহাটের বাইরে পা দেয়নি, সে জমিজমা বেচে চড়ে বসেছিল প্লেনে। সোয়েটার শাল আর হনুমান টুপি সম্বল করে পাড়ি দিয়েছিল আইসল্যান্ড।
অদ্ভুত লাগছে? বাঃ। ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে বলা নেই কওয়া নেই, পুকুর ধারের জমিটা হাতবদল হয়ে হালফ্যাশনের পেল্লায় ওয়েলনেস রিসর্ট হল, বাবু-বিবিরা গাড়ি চড়ে উইকএন্ড ট্রিপে ভিড় জমালেন এটা অদ্ভুত না? ছোট্ট একটা মুঠো ফোন, তার মধ্যে দিয়ে নিমেষে পাচার হয় রগরগে জোকস এলিট-সাবঅল্টার্ন নির্বিশেষে আমোদে চক্ষু চকচক! এটা অদ্ভুত না? ইন্টারনেটে আইনস্টাইন আর আনাল সেক্স, একটা মাউস ক্লিকের দূরত্ব। অদ্ভুত না?
দেখতে গেলে সবই অদ্ভুত, দেখতে গেলে সবই স্বাভাবিক। আইসল্যান্ডের আগ্নেয়গিরিতে যে ছাই ওড়ে, তার কণা কখন কোন পথে উড়ে পড়বে বসিরহাটে, তাই বা কে জানে! সাড়ে তিন বছর আগে আইসল্যান্ডে সেই যে ছাইয়ের মেঘ ঘনাল, ইউরোপের বিমান চলাচল ছত্রখান হয়ে পড়ল তার ক’দিন পরেই তো অঞ্জনিপুত্রের বাড়িতে কম্পিউটার ঢুকল! পিছু পিছু উইকিপিডিয়া ঢুকল, চ্যাট ঢুকল, ওয়েবক্যাম ঢুকল...আইসল্যান্ডও ঢুকে পড়ল।
ঘরে বসে সারা দুনিয়ার সাথে
যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোতে
ঘুচে গেছে দেশ কাল সীমানার
গণ্ডি
আহা আহাহাহা...
আর সব বাদ দিয়ে আইসল্যান্ড কেন, জিজ্ঞেস করছেন? ঠিকই। লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্কও ঢুকতে পারত। ঢুকতেই পারত। কিন্তু ভেবে দেখুন, পৃথিবীটা খুব ছোট হতে হতেও এখনও যে কয়েকটা নাম প্রত্যন্তের ইশারা জাগায়, আইসল্যান্ড তেমনই একটা। অঞ্জনিপুত্র লন্ডন বা প্যারিস গেলে এই নোহোয়্যার-এর ব্যঞ্জনা তৈরি হত না। তাই আইসল্যান্ড। ‘হনলুলুর মাকুদা’ গল্পে হনলুলুর মতো।
|
|
যাক, দার্শনিক কথাবার্তা অনেক হল। এ বার ছবির রিভিউয়ে আসি। ‘হনুমান ডট কমে’র রিভিউ। এতক্ষণ যে কথাগুলো লিখছিলাম, সেটা ওই ছবি দেখারই প্রতিক্রিয়া। গৌরব পাণ্ডের আগের ছবি ‘শুকনো লঙ্কা’ দেখে ভাল লেগেছিল। ভাল লাগার মতো বহু উপাদানই তার মধ্যে ছিল। পরের ছবি ‘হনুমান ডট কম’ মেজাজের দিক থেকে অনেকখানি আলাদা। আইসল্যান্ড নয়, আউট অফ দ্য বক্স কাহিনি নির্বাচনই তার আসল চমক। দুষ্টু-মিষ্টি আরবান ফ্লিক অথবা বাঙালি নস্টালজিয়ার কোনও তুরুপ-তাসকে পুঁজি করে বাজার গরম করাই যখন দস্তুর, তখন এটা দুঃসাহস ছাড়া কী! বিনোদন শব্দের মানেটা ক্রমশ যে ভাবে গ্ল্যামার আর ফিল গুডের সমার্থক হয়ে যাচ্ছে, সেখানে ভাবনা-নির্ভর ছবি করাটাই বড় দুঃসাহস।এই দুঃসাহসটা দেখানোর জন্যই গৌরব পাণ্ডে বেশ খানিকটা কৃতিত্ব দাবি করবেন। আর পাঁচটা ছবির চেয়ে এ ছবি মেজাজে অনেকখানি আলাদা, ভাবনার যথেষ্ট খোরাক তার মধ্যে আছে। আইসল্যান্ডে বাংলা ছবির শু্যটিং হচ্ছে, বিদেশি কাস্ট অ্যান্ড ক্রু বাংলা ছবির শরিক হচ্ছেন এগুলো অবশ্যই খবর। কিন্তু আজকের যে সময়, যে বাস্তবতা অঞ্জনিপুত্রের গল্পটা জন্ম দেয়, সেই সময় আর সেই বাস্তবতাই ‘হনুমান ডট কম’ ছবিটা বানিয়েও ফেলে। সত্যিকার খবর এটাই। এবং এখানে খুব জরুরি সংযমও দেখিয়েছেন পরিচালক। ছবিটা কোথাও আইসল্যান্ডের ট্যুরিস্ট গাইড হয়ে ওঠেনি।
মূল সমস্যাটা হল অন্যত্র। হনুমানের গল্পের আইডিয়াটা নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। ছবির ভাঁজে ভাঁজে নানা ধরনের রেফারেন্স বুনে দেওয়া আছে। সেগুলো যাঁরা খুঁজে নিতে পারবেন, মজা পাবেন। ছবির লুকটাও বেশ অন্য রকম। সামগ্রিক ভাবে ছবির চেহারায় একটা কম্পিউটার স্ক্রিন-এফেক্ট আছে। সেটাও গল্পের সঙ্গে বেশ মানানসই। কিন্তু আইডিয়া থেকে নিটোল গল্পের উত্তরণে একটা ফারাক থেকে গিয়েছে। সেই কারণেই প্রথমার্ধটা ভাল এগিয়েও দ্বিতীয়ার্ধে এসে গল্পটা ঝুলে গিয়েছে। দ্বিতীয়ার্ধটা থ্রিলারধর্মী অথচ থ্রিলারসুলভ সাসপেন্স, গতি বা টুইস্ট সেখানে নেই। কাহিনি কোন দিকে যাবে এবং কোন পথে যাবে, সেটা পুরোটাই প্রেডিক্টেবল। প্রেডিক্টেবল হয়েও কোনও কোনও গল্প আকর্ষণ ধরে রাখতে পারে। কিন্তু সেটা খুব কঠিন কাজ। তার জন্য গল্পে আরও নানা ধরনের বিনোদন থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে সেটা তেমন ভাবে ছিল না। ছবির চলনটাও বেশ মন্থর। এই অংশটার সম্পাদনা নিয়ে পরিচালক আর একটু ভাবলে পারতেন।
গানের সংখ্যাও একটু কমলে ভাল হত। গান নিয়ে এমনিতে ছবি জুড়ে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষাই আছে (সঙ্গীত, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত)। ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’, গানটা তো ট্রিবিউট হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছে। সেটা ভাল লাগে। ইকড়িমিকড়ি-র র্যাপটাও মজার। এ ছাড়া বাকি গানগুলো আলাদা করে তেমন মাত্রা যোগ করেনি। সংলাপও সর্বত্র দাগ কাটেনি। বিশেষ করে অঞ্জনিপুত্র এবং তার স্ত্রীর মধ্যেকার সংলাপে আরও মাজাঘষা দরকার ছিল। এ ধার-ও ধার বেশ
কিছু লজিকাল গ্যাপও চোখে না-পড়ে পারে না।
অভিনয়ে পরিচালক নিজে, অঞ্জনিপুত্রের সহকর্মীর ভূমিকায় কৌশিক সেন, কেব্ল মিস্ত্রি রুদ্রনীল ঘোষ খুবই ভাল করেছেন। মেয়েদের মধ্যে সাসকিয়া আর মৌসুমী দু’জনে চেহারায়, চরিত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। এই বৈপরীত্যটা গল্পের পক্ষে বেশ সহায়ক। তবে অভিনয় দু’জনের কারওরই ভাল নয়। তার চেয়ে
বরং দেখতে বেশি ভাল লাগে পরিচালক-তনয়া সালোনিকে। সর্বক্ষণ কম্পিউটার আঁকড়ে বসে থাকা একটি মেয়ে। সে-ই অঞ্জনিপুত্রকে সাহায্য করে, সাহস দেয়।
এবং প্রসেনজিৎ। এতগুলো বছর ধরে ম্যাটিনি আইডল হিসেবে রাজত্ব করার পরে এতটা সারল্যের অভিনয় করাটা খুব কঠিন। প্রসেনজিৎ করেছেন। ডিগ্ল্যামারাইজড দেখানোর জন্য এক মুহূর্তের জন্যেও নিজেকে অসুন্দর করে তুলতে হয়নি তাঁকে। চুলে কোনও বেঢপ ছাঁট না, কোনও উৎকট চশমা না। এমনিই সুন্দর, সহজ, সরল। অঞ্জনিপুত্রের মতোই। |
|
|
|
|
|