রাজ পরিবারের কুলদেবী মন্দির থেকে একাধিক বিগ্রহ আর অলঙ্কার নিয়ে পালাচ্ছিল ‘লুটেরা’র দল। তাদের পরিকল্পনায় বাধ সাধলেন এক যুবক। তাঁর সাহসিকতায় চোরাই মূর্তি-গয়না ফেলেই চম্পটি দিল লুটেরারা।
শনিবার রাতে পুরুলিয়ার কাশীপুরের ঘটনা। সুশান্ত রক্ষিত নামে ওই যুবকের তৎপরতায় রক্ষা পেয়েছে পঞ্চকোট রাজবংশের কুলদেবী রাজ রাজেশ্বরীর মন্দিরের মহামূল্যবান একাধিক মূর্তি। কাশীপুর রাজবাড়ির মন্দিরের পুরোহিতকে বেহুঁশ করেই লুটেরারা ওই কাণ্ড ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে পুলিশের অনুমান। রবিবার ঘটনাস্থলে আসেন রঘুনাথপুরের এসডিপিও কুন্তল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “ওই যুবক ধাওয়া করলে একটা ব্যাগ ফেলে দুষ্কৃতীরা পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ধাওয়া করে। কিন্তু, মোটরবাইকে চড়ে তারা যায়।”
পঞ্চকোট রাজবংশের কুলদেবীর এই মন্দিরটি কাশীপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৪ সালের ৪ মে। এই রাজবংশ যেমন যেমন ভাবে তাদের রাজধানী পরিবর্তন করেছিল, তেমন ভাবেই তাদের কুলদেবীর মন্দিরও রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পুরুলিয়ার গড় পঞ্চকোট, পাড়া, কেশরগড়ের পরে কাশীপুর ছিল এই বংশের শেষ রাজধানী। স্থানীয় সূত্রের খবর, শনিবার রাতে রাজ-মন্দিরের কাছের মাঠে যাত্রা চলায় রাস্তাঘাট তুলনামূলক ভাবে ফাঁকা ছিল। এসডিপিও বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে, ওই সুযোগে দুস্কৃতীরা মন্দিরের পিছনের ভাঙা পাঁচিল পেরিয়ে ঢুকে মূর্তি নিয়ে পালাচ্ছিল। তখনই তারা সুশান্তর মুখে পড়ে যায়।” |
মন্দিরের রাস্তাতেই সুশান্তর বাড়ি। রাত ১১টা নাগাদ তিনি ও তাঁর পড়শি ফটিক কর্মকার যাত্রা দেখে বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁরা দেখেন, জনা চারেক যুবক মন্দিরের দিক থেকে আসছে। তাদের মুখ বাঁধা। পিঠে রুকস্যাক। তারা কোথা থেকে এসেছে, সুশান্তরা তা জানতে চাইতেই তারা ছুটতে শুরু করে। সুশান্ত তাদের ধাওয়া করেন। সুশান্তর কথায়, “অনেকটা ধাওয়া করে পিছনের ছেলেটাকে ধরে ফেলি। জাপটে ধরতে যেতেই ওই যুবক আমাকে ঘুষি মেরে ফেলে দেয়। আমি পড়ে গেলেও ওর পিঠের ব্যাগ ছাড়িনি। ব্যাগটা পড়ে যায়। চার জনই পালিয়ে যায়।” সুশান্তর চিৎকারে যাত্রার আসর থেকে লোকজন ছুটে আসেন। ব্যাগ খুলতেই দেখা যায়, ভিতরে একাধিক মূর্তি। খবর পেয়ে চলে আসেন কাশীপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সৌমেন বেলথরিয়া, পঞ্চকোট রাজবংশের অন্যতম সদস্য প্রশান্ত কিশোর লাল সিংহদেও। তাঁরা পুরোহিতকে ঘুম থেকে তুলে দেখেন, মন্দিরের মূল দরজা ভাঙা। কুলদেবী যে ঘরে অধিষ্ঠিতা, সেখান থেকে গোটা পাঁচেক মূর্তি উধাও। রাজবংশের আর এক সদস্য ভগবতী প্রসাদ সিংহদেও বলেন, “মন্দির থেকে মায়ের রুপোর সিংহাসন, রুপোর ছাতা, জয়া-বিজয়ার দু’টি ধাতব মূর্তি-সহ বেশ কিছু অলঙ্কার আর টাকা নিয়ে পালিয়েছিল চোরের দল। রবিবার সকালে মায়ের মূর্তি আমরা ওই ঘরেই খুঁজে পাই।” মন্দিরের পাশের ঘরেই পুরোহিত ঘুমোন। অথচ তিনি কিচ্ছু টের পাননি। স্থানীয় বাসিন্দারা অনেক ডাকাডাকি করে তাঁকে ঘুম থেকে তোলেন। পুলিশের ধারণা, চোরেরা কিছু ‘স্প্রে’ করায় বেহুঁশের মতো ঘুমিয়েছিলেন পুরোহিত নারায়ণ দেওঘরিয়া। তাঁর কথায়, “আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। রাত সাড়ে আটটায় মা শয়নে যান। তার পর আমিও মন্দির বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ঠান্ডা ছিল বলে শুয়ে পড়েছিলাম।”
কাশীপুরের বিধায়ক স্বপন বেলথরিয়া বলেন, “এটা সাধারণ কোনও চোরের কাজ হতে পারে না। কোন মূতি পাচার চক্র এর পিছনে রয়েছে কি না, তা পুলিশের খতিয়ে দেখা দরকার।” এসডিপিও বলেন, “এটা অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। কয়েক জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কিছু জিনিস এখনও উদ্ধার করা যায়নি।” তবে, সুশান্তর সাহসিকতার প্রশংসা করছেন পুলিশকর্তা থেকে এলাকার মানুষসকলেই। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সৌমেনবাবু বলেছেন, “যে যুবকের জন্য ওই প্রাচীন মূর্তিগুলি রক্ষা পেয়েছে, তাঁর সাহসের প্রশংসা করতেই হয়।” |