|
|
|
|
|
|
|
সুমনামি |
কবীর সুমন
|
এর আগের বারের লেখার শেষ দিকে বলেছিলাম ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গাওয়া, আমার ছেলেবেলায় শোনা ‘মুক্ত কর্ মা মুক্তকেশী’ গানটির কথা। প্রথম শোনাতেই ঘায়েল হয়ে গিয়েছিলাম। গানটি শুরুই হল মধ্যসপ্তকের শুদ্ধ নি থেকে। দু’মাত্রা পর ‘কর্ মা’ শব্দ দুটি শুদ্ধ ধা থেকে তারসপ্তকের সা। তারার ষড়জে চার মাত্রা। ওই চার মাত্রায় মনে হয়েছিল সময় স্থির হয়ে গেল চিরকালের মতো। গম্ভীর অথচ মোম-হয়ে-যাওয়া ঘন-মধুর মতো গলায় এক জন মানুষ শুধু তারসপ্তকের ষড়জে স্থিত হলেন। প্রথম শুনেই মনে হয়েছিল আমি ঢুকে গেলাম ওই সুরটার মধ্যে। পরে, যখনই এই গানটি ভেবেছি মনে হয়েছে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য তারসপ্তকের ‘সা’-এ স্থিত হয়ে আছেন। মহৎ শিল্পীরা যখন ষড়জে, সুরে স্থিত হন— মনে হয় ব্ল্যাক হোল। ওখানে ঢুকলে আর বেরোতে পারব না।
‘তারা, কতদিনে কাটে আমার
এ দুরন্ত কালের ফাঁসি
মুক্ত কর্ মা মুক্তকেশী।’
বাল্যকালে বেতারে বার দুই-তিন শুনেছি বড়জোর। ‘তারা’ থেকে শুরু করে ‘ফাঁসি’ পর্যন্ত গানের অংশটি এমন ভাবে গাওয়া যেন দুরূহ স্বরবিন্যাস অনায়াসে গেয়ে দেওয়ার সেরা দৃষ্টান্ত সেখানে অনন্ত কালের জন্য রাখা।
বাংলা ভক্তিগীতি, শ্যামাসংগীত আমার চেনাজানা সংগীতরসিকদের কেউই কোনও ধর্মীয় কারণে বা ভক্তির কারণে শোনেনি। হিন্দি ভজনের বেলাতেও একই কথা বলব। ডি ভি পালুশকরের গাওয়া ভজনগুলির রেকর্ড শুনে ছেলেবেলায় যে আনন্দ হত, আজও সেই আনন্দই পাই। ‘রঘুপতি রাঘব রাজারাম’ গানটি শুনেছিলাম মহাত্মা গাঁধীর প্রিয় ছিল। ডি ভি পালুশকরের গাওয়া এই ভজনটি শুনে ছেলেবেলায় আপনমনে ভাবতাম ছোট ছোট যে সব তান ও বিদ্যুতের মতো ছুটতান আমার পেটের ভেতর কী যেন একটা করে দিচ্ছে, মাথাটা দিচ্ছে ঘুরিয়ে, এগুলো শুনে মহাত্মা গাঁধী কী করতেন! তাঁর দেহেমনেও কি একই শিহরন জাগত? |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী। |
১৯৯৬ সালে কলকাতায় গাইতে এসে পিট সিগার তাঁর নজরুল মঞ্চের অনুষ্ঠানে হঠাৎ ‘রঘুপতি রাঘব’ গানটি ধরেন। তার আগে তিনি আমায় মঞ্চে ডেকে নিয়েছিলেন। আমি তাঁর বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে সংগত করছিলাম— কণ্ঠে (প্রয়োজন মতো স্বরসংগতি করে) ও গিটারে। পিট সিগারকে দেখে বুঝতে পারছিলাম কতটা মন দিয়ে, সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে তিনি ‘রঘুপতি রাঘব রাজারাম’ গাইতে চেষ্টা করছেন। হিন্দি কথাগুলিকে কবজা করতেই তো তাঁর ঘাম ছুটে যাচ্ছিল। তার ওপর ভারতীয় গানের সুরের চলন সামলানো, যা পাশ্চাত্যের সুরারোপ-পদ্ধতি ও গায়নরীতি থেকে অনেকটাই আলাদা। মনে আছে, দর্শকদের মধ্যে এক পরিচিত র্যাডিকালপন্থী ছিলেন। গানটি শুরু হতেই তিনি বলে উঠলেন ‘হোয়াই রঘুপতি রাঘব?’ শ্রীরামচন্দ্রের কথা ভেবে পিট সিগার ওই গানটি গাননি। এই গানটি তাঁর কাছে ভক্তিগীতি না। মহাত্মা গাঁধীর প্রিয় গান, তাই ভারতে এসে এই গানটি গেয়েছিলেন আমেরিকার প্রবাদপ্রতিম লোকশিল্পী।
হিন্দি ভজন ও বাংলার শ্যামাসংগীত আমি ভক্তির কারণে ততটা শুনিনি, যতটা শুনেছি গানগুলির সুরসৌষ্ঠব, সাংগীতিক আবেদনের কারণে। এক কালে ফাজিল বাঙালি এক দিকে ‘আয় হনুমান কলা খাবি/ জয়-জগন্নাথ দেখতে যাবি’ বলত, আর অন্য দিকে কলকাতার তানসেন বা সদারঙ সংগীত সম্মেলনে সুনন্দা পট্টনায়কের কণ্ঠে ‘জগন্নাথ-সোয়ামি’ গানটি না শুনলে মুখ করত হাঁড়ি। অনুষ্ঠানে তাঁর ভয়ানক উচ্চকিত, বিধ্বংসী খেয়াল আমি অন্তত আমার যৌবনে সহ্য করতাম স্রেফ একটি মাত্র আশায়: এর পর এই মহাগায়িকা একেবারে অন্য ভঙ্গিতে গাইবেন ‘জগন্নাথ-সোয়ামি’।
পান্নালাল ভট্টাচার্যের উচ্চারণ তাঁর কিংবদন্তিসুলভ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ও আধুনিক গানের সম্ভবত শ্রেষ্ঠ শিল্পী শ্যামল মিত্রর উচ্চারণের মতোই কিঞ্চিৎ ত্রুটিযুক্ত ছিল। তিন জনেই ‘হয়ে’-কে ‘হইয়ে’, ‘সয়ে’-কে ‘সইয়ে’, ‘পেয়ে’-কে ‘পেইয়ে’ বলতেন। পান্নালালের গাওয়া ‘মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন’, কী মুশকিল, ‘মাইয়ের পাইয়ের জবা হইয়ে’র মারাত্মক কাছাকাছি শোনানোর কারণেও আমার ভাল লাগত না। তা ছাড়া, গানটির খ্যামটা-গোছের চলন বিরক্তিকর লাগত। কিন্তু তাঁরই গাওয়া ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’ (যত দূর জানি, কাজী নজরুল ইসলামের রচনা), ‘দোষ কারো নয় গো মা’ বা ‘আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী’ আজও অনবদ্য লাগে।
এ জীবনে দু’এক বার শুনেছি ‘শ্যামাসংগীত’-কে কেউ কেউ ‘মায়ের নাম’ বলছেন, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা খুবই কম। বাংলার শ্রোতার কাছে ‘শ্যামাসংগীত’ সেকুলার সংগীতরূপ— ভজনের মতো। উপমহাদেশের সনাতন সংগীতের এ এক চমৎকার দিক, যা পাশ্চাত্য সংগীতে অন্তত নেই। আচার্য বড়ে গোলাম আলি খান রেকর্ড করছেন ‘হরি ওম্ তৎসৎ।’ কী তাঁর গায়কির গরিমা, লালিত্য ও মাধুর্য। ঠুংরি আঙ্গিকে পাহাড়ি রাগে গানটি গাইতে গাইতে ওই রাগের বর্ণোজ্জ্বল রূপটি কী প্রবল কল্পনাশক্তি ও রসবোধ দিয়েই না ফুটিয়ে তুলছেন তিনি। পাহাড়ি রাগে যে সব ছোট ছোট তান ও অশ্রুতপূর্ব স্বরপরম্পরা আচার্য বড়ে গোলাম খান প্রয়োগ করছেন, সেগুলিতে ভক্তি-গদগদ ভাব নয়, সংগীতে অলৌকিক সৃজনশীলতার অধিকারী এক শিল্পীর পরিমিত উল্লাস, সাংগীতিক কল্পনাশক্তির অ্যাডভেঞ্চার আর উদ্যাপন।
কালক্রমে রইল না কিছুই— অন্তত ব্যবহারিক সংগীতে তো নয়ই। ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হুংকার ‘জয় শ্রীরাম’ এল। হারিয়ে গেল ডি ভি পালুশকরের গাওয়া ‘যব্ জানকিনাথ সুহাগ করে’, ‘ঠুমক্ চলত্ রামচন্দ্র’। ঠিক যেমন পদাবলি কীর্তন হারিয়ে গেল বললে অত্যুক্তি করা হবে না।
গত শতকের ষাটের দশকে তো বটেই, এমন কী সত্তরের দশকেও বেতারে অল্পবিস্তর পদাবলি কীর্তন শোনা যেত। ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, রথীন ঘোষ ও তাঁর সম্প্রদায়। বেতারই ছিল এই সমাজে গানবাজনা শোনার প্রধান, অনেকের ক্ষেত্রে একমাত্র জায়গা। বেতার-প্রচারিত নানান ধরনের গানবাজনা আমাদের ঘিরে রাখত। আমার বাবা, সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছিলাম— পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে বা ষাটের গোড়ায় এক দিন তিনি আকাশবাণী ভবনে ঢুকতে গিয়ে দেখতে পান স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্র দে দরজার কাছে দারোয়ানের টুলে বসে আছেন। দৃষ্টিহীন কৃষ্ণচন্দ্র দে গলার আওয়াজে মানুষ চিনতেন। বাবা তাঁকে প্রণাম করে জানতে চান কেন তিনি ওই ভাবে বসে। বাবার মাথায় হাত রেখে তিনি বলেন, ‘কে? সুধীন্দ্র? এই যে বাবা, তোমাদের ডায়রেক্টর সায়েবের কাছে তদবির করতে এসেছি। পদাবলি কীর্তন তো আধ ঘণ্টাতেও ভাল হয় না। তোমাদের সমস্যার দিকটা আমি জানি। তাই আর সময় চাইনি। আধ ঘণ্টাই মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু দ্যাখো বাবা, কীর্তনের প্রোগ্রামের সময় ছাঁটতে ছাঁটতে কুড়ি মিনিট, তার পর পনেরো, এ বারে দ্যাখো দশ মিনিট করে দিয়েছে। খেয়ালের জন্য তো তোমরা আধ ঘণ্টা দাও। তা আমি তদবির করতে এসেছি— দশ মিনিটে তো পদাবলি কীর্তন হতে পারে না, তাই অন্তত পনেরো মিনিট যদি আমাকে দয়া করে দেওয়া হয়।’
বাবা আমায় কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘আমি তোকে বলে রাখলাম, যে দেশে কৃষ্ণচন্দ্র দে’কে এই ধরনের তদবির করার জন্য আকাশবাণীর দারোয়ানের টুলে বসে থাকতে হয়, কেউ এক জন তাঁকে ভেতরেও নিয়ে যায় না, সেই দেশে সংগীত হবে না। শেষ হয়ে যাবে।’
ভারতের কথা জানি না। বাংলার সংগীতজগতের দিকে তাকিয়ে আজ বুঝতে পারি কথাটা মিলেই যাচ্ছে। |
|
|
|
|
|