রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১...
স্ক্র্যাপ কথা
সে বেশি আগের কথা নয়। তখন আমাদের হাতে মোবাইল ছিল, কিন্তু মোবাইলে ইন্টারনেট ছিল না। পেনসিলবক্সের মতো মোবাইল, আর তার পাড়া কাঁপানো রিংটোন। এক বন্ধু কালার মোবাইল কিনেছিল, আমরা বলেছিলাম বাপের পয়সায় ফুটানি মারছে। কলেজের বাইরে আমাদের ঠেক ছিল অভিজিৎদার চায়ের দোকান। কলেজ ড্রপ-আউট সেই টেক-স্যাভি অভিজিৎদা, যে সবজি কাটত কাশ্মীরা শাহ-র বিকিনি পরা একটা পোস্টারের উপরে। সে দিনও জানতাম ট্যাবলেট শুধুই খাওয়ার জিনিস। মোবাইলে ভিজিএ ক্যামেরা ছিল সাত রাজার ধন। কলেজ ক্যান্টিনের, অভিজিৎদার ঠেকের, সোশালের কত ‘সেএএ চিইজ’ বন্দি হয়েছিল সেই সব ভিজিএ ক্যামেরায়। ‘অরকুটে দিবি তো?’ রাতে ক্যামেরা-ফোনের বন্ধুকে এসএমএস— নেহার সঙ্গে আমার ছবিটা আপলোড করে দিস বস, শ্রীতমাকে মুখের মতো জবাব দিয়ে দেওয়া যাবে! দেখবে আর জ্বলবে, লুচির মতো ফুলবে। অরকুুট ছিল ঘ্যাম দেখানোর রাস্তা।
আমাদের কলেজ জীবনের প্রথম বারোয়ারি ডিজিটাল সিন্দুক— সেই অরকুুট। খাটের তলায় অযত্নে ফেলে রাখা অনেক পুরনো ট্রাঙ্কটার মতন। যার ধুলো ঝাড়া হয় না বহু দিন। সেই এক্কেবারে ছোটবেলায় পাওয়া চাবি দেওয়া লেজ ঘোরানো কুমিরটার মতই সেখানে মমি হয়ে আছে কত ক্যাসেট, অবহেলার ফাংগাস লেপে যাওয়া সেই ক্যাসেটের খয়েরি ফিতে। ‘তোমাকে চাই’-এর প্রথম প্রিন্ট।
ল্যাপটপের ওয়েব ব্রাউজারের হোমপেজ গুগ্ল। সম্প্রতি এক বন্ধুর ফোন পেলাম মধ্যরাতে। আমার নতুন ফোনটা ঝিনচ্যাক। পাঁচ ইঞ্চি স্ক্রিন, তুলোর মতো টাচ-সেন্সর, কাস্টমাইজড রিংটোন। অচেনা নম্বর। ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘হু ইজ দিস? এত রাতে?’ উত্তর এল, ‘ডোন্ট হুইসপার ভাই। স্টে ফ্রি! আমি তো লাঞ্চ করছি এখন। দেবদূত বলছিলাম ডেনভার থেকে। এফ-বি থেকে তোর নম্বরটা পেলাম। ভাবলাম হাই বলি। যাক গে, ঘুমো। কাল কথা হবে। গুড নাইট। চিয়ার্স।’ সেই দেবদূত, কলেজে যার নাম চেঞ্জ হয়ে গিয়ে দাঁড়ায় স্বামী অরকুটানন্দ। কলেজের সময়টুকু বাদ দিলে বাকি সারা দিন অরকুটে কুটকুট করত বলে ওর এই নাম। দেবদূতের ফোনে ঘুমটার লিংক ফেলিয়োর হল। আর মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করতে লাগল— ‘অরকুট’। সে কি আছে? বেঁচে আছে? ল্যাপটপ খুললাম। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো, গুগ্লে লিখলাম, অরকুট।
ভাবলাম প্রথমেই আসবে উইকিপিডিয়া। লেখা থাকবে, ‘ইট ওয়াজ এ ভেরি পপুলার সোশাল নেটওয়ার্কিং...।’ অথবা ব্রাউজার হয়তো বলবে ‘দিস পেজ ডাজ্ন্ট এগজিস্ট’। ও মা! কী আশ্চর্য। পয়লা এন্ট্রিতে জ্বলজ্বল করে উঠল— অরকুট। সে আছে! দে শালা পাসওয়ার্ড। জি-মেলেরটাই হবে নিশ্চয়ই। ভুলে যাওয়া দিনগুলি রিসাইকল বিন থেকে আমায় যে পিছু ডাকে। লোডিং...। এসেছে, এসেছে...এসেছে বঁধু হে। টেস্টিমোনিয়াল, স্ক্র্যাপ। সেই ফেলে আসা কত কত শব্দ। নিজেদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই ছিল স্ক্র্যাপ নিয়ে। কে কত পপুলার তা মাপার রাস্তা ছিল কার ভাঁড়ারে কত স্ক্র্যাপ। চার বছর আগের থেমে থাকা সময় স্ক্রিন জুড়ে। না আপডেট হওয়া কত ওয়াললিখন। স্টেটাস আপডেট।
এই তো আকাঙ্ক্ষা। সিংগল। আয়্যাম লুকিং ফর এ কিউট বয়ফ্রেন্ড। শেষ আপডেট ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮। বয়ফ্রেন্ডটা কিউট হয়েছিল কি না জানি না। তবে আকাঙ্ক্ষার আজ ডিভোর্সের মামলা চলছে। ফেসবুকে ওর শেষ লেখা দেখেছিলাম ‘ফিলিং গ্লুমি’।
রূপঙ্কর। ‘ক্যাম্পাসিং ডান...৩টে অফার। অন দ্য মুন।’ পরশুই কথা হল রূপঙ্করের সঙ্গে। বেঙ্গালুরুর ষোলো তলা আইটি ফার্মে চার বছরেরও বেশি চাকরি করে, নিউ জার্সি আর আমস্টারডামে দু’বার অন সাইট করে এসে এ বছরের ফেব্রুয়ারির এক সকালে দুম করে ও যখন পিংক স্লিপ পায়, অফিসের ছাদ থেকে ফোন করে ঝাপসা গলায় বলেছিল, ‘ঝাঁপাব রে। বাড়িতে খবর দিতে পারবি?’ অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে আর হোয়াট্স্অ্যাপে দিনের পর দিন মোটিভেশনাল কোটস আর শিভ খেরা-র ভিডিয়ো পাঠিয়ে আমরা কোনও মতে ওকে সামলাতে পেরেছিলাম। কলকাতায় ফিরে রূপঙ্কর এখন সরকারি চাকরির প্রস্তুতি শুরু করেছে জোর কদমে। ফেসবুকে ওর এখন স্টেটাস ‘ফরগেটিং রাবিশ। প্রিপেয়ারিং ফর দ্য ট্রু জব।’ কলেজলাইফে ওর বেডরুমে লাগানো থাকত হার্লে ডেভিডসনের বাইক আর ক্যাটরিনা কাইফের পোস্টার, আজকাল সাঁটানো থাকে কাগজের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন— সরকারি চাকরিতে যারা সফল হল, তাদের ছবি।
পেজ ডাউন করি। মোনালিসার সঙ্গে তমাল। ফুচকা খাচ্ছে। তমাল থাকত বনগাঁয়, মোনালিসা সল্টলেকে। আর্থিক অবস্থার আকাশপাতাল তফাত। তা সত্ত্বেও এক সঙ্গে ঘুরত। মোনালিসা প্রতি দিন একস্ট্রা টিফিন নিয়ে আসত তমালের জন্য। বলত, ‘উই আর জাস্ট ফ্রেন্ডস। সহজ অ্যান্ড সিম্পল ছেলেদের আমার খুব ভাল লাগে। তমালের মধ্যে কী সুন্দর একটা ইনোসেন্ট ইনোসেন্ট লুক আছে।’ আর তমাল বলত, মোনার জন্যে আমার মনকেমন। কলেজ ছাড়ার মাস ছয়েক পরে করুণাময়ীর বাসস্ট্যান্ডে ছেলেটা যখন মেয়েটার আঙুলগুলো ধরে প্রেমের প্রস্তাব দেয়, মোনালিসা তমালকে ঠাটিয়ে থাপ্পড় মেরেছিল। তমাল কিন্তু অরকুুট থেকে ছবিটা আজও ওঠায়নি। ওঠানোর কথা মাথাতেও আসেনি হয়তো। তত দিনে আছড়ে পড়েছে ফেসবুক ঝড়। দিনে অন্তত দু’বার করে ওয়াল আপডেট হচ্ছে। কলেজের ফাইনাল ইয়ারে ওঠার পর থেকেই অরকুুটে স্ক্র্যাপের জীবাশ্মগুলো নিয়ে আমরা আর মাথা ঘামাতাম না। লিখন তোমার ধূলায় হয়েছে ধূলি। ডিজিটাল ধুলো। তমালের ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্ট কিন্তু মোনালিসার থেকে শত যোজন দূরে।
এই তো বুধাদিত্য সমাদ্দার। ‘মেরা নাম্বার কব আয়েগা।’ জয়েন্টে র্যাংক ভাল থাকলেও বায়োকেমিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে ভরতি হয়েছিল আমাদের কলেজে। বেচারা। ক্যাম্পাসিংয়ের দাবিতে যে দিন কলেজের প্রিন্সিপালসুদ্ধ সব ফ্যাকাল্টিদের রাতভর ঘেরাও করে রেখেছিলাম, লিড রোল নিয়েছিল এই বুধাদিত্য। টিপিও, মানে ট্রেনিং অ্যান্ড প্লেসমেন্ট অফিসারকে চমকে সে বার ভালই কাজ হয়েছিল। মাসখানেকের মধ্যেই ক্যাম্পাসিংয়ের ধুম পড়ে আর মাসতিনেকের মধ্যেই কলেজের সবার প্লেসমেন্ট হয়ে যায়। শুধু বায়োকেমিকাল ছাড়া। ‘অড’ স্ট্রিম বলে কোনও সফ্টওয়্যার কোম্পানি ওদের ক্যাম্পাসিংয়ে বসতে দেয়নি। ফাইনাল ইয়ারের মাঝামাঝি অরিজিৎদার ঠেকে বসে যখন টিসিএস ভাল না আইবিএম— এই নিয়ে আমাদের মধ্যে গর্বিত তর্ক হত, বুধাদিত্যকে দেখতাম বুট না-হওয়া কম্পিউটারের মতো ব্ল্যাংক স্ক্রিন নিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। সেই বুধাদিত্য এক দিন এসেছিল আমাদের কাছে। ‘ভাই তোদের জন্য এত করলাম। অথচ দ্যাখ, আমাদের এক জনেরও প্লেসমেন্ট হল না। আমরা আবার আন্দোলন করব। পাশে দাঁড়াবি?’ প্রোমোশনাল এসএমএসের মতো বুধাদিত্যর অনুরোধ ডিলিট করেছিলাম সে দিন। ও শেষ পর্যন্ত ফিরে যায় ওর দেশে, মেদিনীপুরে। খালি হাতেই। সেখানে ছোটখাট ব্যবসা শুরু করে। ওষুধের। ওর ফেসবুক প্রোফাইলে দোকানের ছবি দেখেছিলাম। এক দিন পিং করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম— দোকান কেমন চলছে? ও বলল— আউটলেট বলবি। দোকান নয়। আর ওষুধ লাগলে বলবি। স্পেশাল ডিসকাউন্ট করিয়ে দেব। ভাল আছি রে। রিসেশনের খবর পড়ে বুক দুরদুর করে না!
ঋতব্রত। ‘আমি রোদ্দুর হতে চাই... টেল মি ফ্রেন্ডস কী উপায়।’ ও কোন আক্কেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছিল ভগবান জানেন। চার-চারটে বছর ধস্তাধস্তি করে বাবু বি-টেক পাশ দিলেন। তিন বছরের মাথাতেই একটি পৃথিবীবিখ্যাত সফ্টওয়্যার কোম্পানি থেকে মোটা মাইনের অফার পেল। সেটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে জয়েন করল একটা বেশ নামী খবরের কাগজে। সাত-আট মাস যেতে না যেতেই বলল, ‘ভাল লাগছে না রে। আমি যা ভাবি, যা বিশ্বাস করি, আর আমাকে যা লিখতে হয়, তার মধ্যে কোনও মিল নেই। বিশেষ করে পলিটিকাল কপিগুলোতে। দমবন্ধ লাগছে।’ এক দিন দুম করে চাকরিটা ছেড়ে দেয়। বেশ কিছু মাস বাড়িতে বসে থাকে। ইচ্ছে হলেই বেড়াতে চলে যেত। একা একা। কাউকে না জানিয়ে। শেষ পর্যন্ত চার দিকের চাপে পড়ে জয়েন করে একটা ইনশিয়োরেন্স কোম্পানিতে। এখন কি ও রোদ্দুর হতে পেরেছে? ওর ফেসবুক প্রোফাইল দেখে সেটা বোঝা যায় না অবশ্য। সেটা রোজ আপডেট হয়। একাধিক বার। ‘ফিলিং হ্যাপি, এ মাসের টার্গেট মিট করলাম’ অথবা ‘আর চার লাখ পেতেই হবে এই দুদিনে’— এ ধরনের কমেন্ট লেখা থাকে।
ঘুম ঘুম পাচ্ছে। অনলের ছবিটা দেখতে পাচ্ছি তলায়। সেই অনল, যাকে প্রায় জোরজবরদস্তি করে অরকুটে অ্যাকাউন্ট খোলানো হয়েছিল। সেই অনল, যে বলেছিল, ‘আমায় দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলাচ্ছিস খোলা। কিন্তু আমি তোদের স্ক্র্যাপের উত্তর দিতে পারব না। এর মধ্যে কোনও উষ্ণতা নেই। এটা মেকি। ডিজিটাল বন্ধুত্বকে পদাঘাত করি আমি।’ ওর অরকুটের স্ক্র্যাপবুকে শেষ এন্ট্রি— ‘আই হেট অরকুট।’ নিজেই লিখেছে। অনল ফেসবুকে নেই। ওকে আমরা বহু বার রিকোয়েস্ট করেছিলাম। প্রতি বার মাছি তাড়ানোর মতো করে উড়িয়ে দিয়েছে। এখনকার দিনে ও সেই বিরল মানুষের এক জন, যে মোবাইল ব্যবহার করে না। অনলাইনও থাকে না কোনও দিন। ওর দাবি, কথা বলতে গেলে মুখোমুখি বসতে হবে। ‘এত সহজে আমি ধরা দেব কেন রে! এই জঘন্য ডিজিটাল-সভ্যতা আমার কাছে দিগন্তবিস্তৃত একটা টিকির মতো। পৃথিবীর যে কোনও কোনা থেকে সেই টিকি ধরে যে কেউ টান দেবে, আর আমার সে দিকে মাথাটা ঝুঁকিয়ে দিতে হবে? আমি বারোয়ারি নই।’
পরের দিন সকালে মোবাইলে এফবি অ্যাপ-এ প্রথম আপডেট। অভিজিৎদা। ‘দোকান ক্লোজ্ড। জয়েনিং এ লিডিং পিৎজা রিটেল চেন।’ সেন্ট ফ্রম স্মার্টফোন।
লাইক করতে পারছি না কেন কিছুতেই?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.