শিল্প যখন ঠোঁটকাটা থাপ্পড়বান
আজকের হিরো: রিমডার্নিস্ট ফিল্ম ম্যানিফেস্টো
ঘোড়াটা পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ওঠে। নাল-বাঁধানো খুরে শব্দ খটাখট খটাখট! পিছনে চাবুক হাতে বৃদ্ধ কোচওয়ান, সে-ও নীরব। শুধু শোঁ শোঁ হিমেল হাওয়া ছাড়া সাউন্ডট্র্যাক-এ আর শব্দ নেই। এক সময় পাহাড়ি কুটির থেকে বেরিয়ে এসে একটি মেয়ে ঘোড়ার লাগাম ধরে। বোঝা যায়, সে এই বৃদ্ধের মেয়ে। মেয়েটি রান্নাঘরে আলুসেদ্ধ করে। মেয়ে-বাবায় কথা নেই। আলু ফুটতে থাকে। এক সময় বাবা, মেয়ে প্লেট নিয়ে খেতে শুরু করে। তবু মুখে সংলাপ ফোটে না। বাইরে বাড়তে থাকে হিমেল হাওয়ার বেগ।
বছর দুয়েক আগে আম্তর্জাতিক কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে দেখা গিয়েছিল এই ছবি। হাঙ্গেরির পরিচালক বেলা টার-এর ‘তুরিন হর্স’। ২০১১ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মানিত ছবি।
পরদা জুড়ে ঘোড়া চলার দীর্ঘ নীরব দৃশ্য বা আলু খাওয়ার ক্লান্তিকর দৃশ্য দেখিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন পরিচালক? শুরুতে পরদায় লেখা, জার্মান দার্শনিক নিট্শে তুরিন শহরে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। সে দিনই রাস্তায় দার্শনিক দেখেছিলেন, কোচওয়ান ঘোড়াকে চাবকাচ্ছে। নিট্শে গিয়ে ঘোড়াটাকে ধরেন, তাঁর পিঠে চাবুক পড়তে থাকে। অতঃপর উন্মাদাগারে নিট্শে। সে কথা সবাই জানে। কিন্তু ভারবহনকারী ঘোড়ার কী হল?
তার পরই বৃদ্ধ কোচওয়ানের পাহাড়ি পথে চলা, শ্বাসরোধকারী ক্লান্তিকর নীরবতা। ওই বৃদ্ধ, তাঁর কন্যা এবং আমাদের মতো দর্শকেরা সবাই কি ওই ঘোড়াটার মতোই বোঝা বয়ে-চলা নীরব জন্তু? রোজই বইতে হয় দৈনন্দিনতার ভয়াবহ নীরব ক্লান্তি? এ যে দেখি আধ্যাত্মিক ছবি!
এই আধ্যাত্মিক ছবির কথাই বলেছিল ২০০৮ সালে জেসি রিচার্ডস-এর ‘রিমডার্নিস্ট ফিল্ম ম্যানিফেস্টো’। ‘রিমডার্নিজ্ম সিনেমায় নতুন ভাবে স্পিরিচুয়ালিটি বা আধ্যাত্মিকতা খুঁজতে চায়। এই আধ্যাত্মিকতা মানে যিশু বা বুদ্ধ নয়। মানুষের জীবনের ছোট ছোট সহজ সত্য, মানবিক মুহূর্তের সন্ধান। স্পিরিচুয়াল ছবি মানে ওই মুহূর্তগুলি ধরা’, বলছে ম্যানিফেস্টো। হাঙ্গেরির পুরস্কারজয়ী পরিচালক সে বার বার্লিনে ওই ম্যানিফেস্টোর কথা প্রচ্ছন্ন ভাবে বলেওছিলেন, ‘এই ছবি অস্তিত্বের ভয়াবহ ভার নিয়ে। তার মানে মৃত্যু নয়। কিন্তু রোজকার জীবন... শীত, গ্রীষ্ম সব সময় সেই এক ভাবে জল আনতে যাওয়া, এক ভাবে খাওয়া... এই একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি বুঝিয়ে দেয়, দুনিয়া কোথায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে।’
বেলা টার পরিচালিত ‘তুরিন হর্স’ ছবির দৃশ্য।
পরদা জুড়ে তাই সংলাপহীন একই দৃশ্যের ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি। ‘দুটি জাপানি চিন্তা উল্লেখ্য। প্রথমটি ওয়াবি-সাবি: অপূর্ণতার সৌন্দর্য। অন্যটি, সব জিনিসই ক্ষণস্থায়ী। তারা শুধু মনে ছাপ রেখে বয়ে যায়। রিমডার্নিস্ট সিনেমা এই চিন্তা মাথায় রেখে অস্তিত্বের সত্য তুলে ধরবে’, লিখেছিল ম্যানিফেস্টো।
কিন্তু দর্শকের পছন্দ-অপছন্দের সত্য? নন্দনে এই ছবির মাঝপথে ৮০% দর্শক বিরক্তিতে উঠে গিয়েছিলেন। কিন্তু কী করা যাবে! ‘সিনেমা মানে গল্প বলা নয়। গল্প আসলে লেখ্য মাধ্যমে। সিনেমা অন্য জিনিস। শব্দ, ছবি ও সময়প্রবাহের ভাস্কর্য’, লিখেছিল ম্যানিফেস্টো। ম্যানিফেস্টো-স্রষ্টা মার্কিন পরিচালক জেসি রিচার্ডসের রিমডার্নিস্ট ধারণা তৈরিতে যে সব পূর্বসূরি প্রভাব ফেলেছেন, তাঁদের নামও ইস্তাহারে পরিষ্কার লেখা আছে। তারকোভস্কি-র ‘আঁদ্রে রুবলিয়েভ’ বা ইয়াসুজিরো ওজু-র ‘টোকিয়ো স্টোরি’। গল্প দেখতে চাইলে এ সব ছবি নৈব নৈব চ। ফিল্ম দেখতে চাইলে অন্য কথা!
কিন্তু সিনেমা যে শুধুমাত্র গল্প বলা নয়, সে কথা পৃথিবীর সব বড় পরিচালক বারবার বলেছেন। রিমডার্নিজ্ম নতুন কী বলল? টুইন টাওয়ার্স ধ্বংস, জর্জ বুশ, একমেরু বিশ্ব পেরিয়ে ২০০৬ সালের এই ম্যানিফেস্টো কয়েকটি জায়গায় চাঁচাছোলা। প্রথমত, সুপার ৮ ও ১৬ মিমি ছবির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ডিজিটাল এবং ভিডিয়ো মাধ্যম এক বাক্যে খারিজ: ‘যারা ভিতু, ভুল করতেও ভয় পায়, তাদের জন্য ডিজিটাল ভিডিয়ো। ভিডিয়ো থেকে একঘেয়ে, বন্ধ্যা ছবি তৈরি হয়।’ দ্বিতীয়ত, পরিচালকের ইনট্যুইশন বা স্বজ্ঞায় জোর। বিচার-বিশ্লেষণ নিশ্চয় থাকবে, কিন্তু মনের ভিতরে স্বতঃলব্ধ অনুভূতি? তার বিকল্প নেই। ‘সৎ ভাবে যোগাযোগের জন্য ইনট্যুইশন সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। রিমডার্নিস্ট ছবি তৈরির সেটিই আসল চাবি। ইনট্যুইশনই জানিয়ে দেবে, তুমি সৎ এবং বিশ্বস্ত ফিল্ম তৈরি করছ কি না!’ এর আগে কোনও আর্ট-ম্যানিফেস্টো এ ভাবে ইনট্যুইশনে এত গুরুত্ব আরোপ করেনি।
কিন্তু ইনট্যুইশনের ওপর এত নির্ভরশীলতা তো ভ্রান্তি ডেকে আনবে! ম্যানিফেস্টোয় মোট ১৫টি পয়েন্ট। ১১ নম্বর: রিমডার্নিস্ট ফিল্মমেকারকে ভুল করার সাহস রাখতে হবে। ভুলের মধ্যেও সততা, সৌন্দর্য এবং মানবিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে! ১২ নম্বরটি আরও মারাত্মক: রিমডার্নিস্ট পরিচালক কখনও সাধুবাদে হ্লাদিত হবেন না। বরং লোকে দেখেও দেখে না, অবজ্ঞা করে... রিমডার্নিস্ট পরিচালক এই সত্য কখনও বিস্মৃত হন না।
মানে, ক্যামেরা বা সাউন্ডস্কেপ সব নয়। পরিচালকের সৃষ্টিসত্তা, তাঁর সাবজেক্টিভিটি-ই মুখ্য। কোনও ছবি যদি বিষয় বা অবজেক্টকে প্রাধান্য দেয়, গ্রহান্তরের জীবন কেমন হবে বা তামিল কন্যার সঙ্গে পঞ্জাবি ছেলে প্রেমে পড়লে কী হবে, সেখানেও পরিচালকের ব্যক্তিচেতনা প্রভাব ফেলবে। ম্যানিফেস্টোর এই জায়গাটা পড়তে পড়তে এক বাঙালি কবির কথা মনে পড়তে পারে, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ।’ সাবজেক্টিভিটিতে এ ভাবে প্রাধান্য দেয় বলেই রিমডার্নিস্ট ম্যানিফেস্টোর বজ্রনির্ঘোষ: ‘বিষয়বস্তু যদি মুখ্য হয়, সেটি অসৎ এবং ক্লান্তিকর ছবি। স্ট্যানলি কুব্রিক এই ধরনের এক পরিচালক।’
শুধু ‘ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’ বা ‘২০০১: এ স্পেস ওডিসি’র বিশ্ববিশ্রুত পরিচালককে এ ভাবে খোঁচা মেরেই ক্ষান্ত হল না ম্যানিফেস্টো। সুইডিশ পরিচালক লার্স ফন ট্রিয়েরের ‘ডগমে ৯৫’ ছবির যে দশ অনুশাসন, ‘মেক আপ, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, অপটিকাল ইলিউশন তৈরি নয়, শুধু হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা’ তাকেও উড়িয়ে দিল এই ইস্তাহার। ‘রিমডার্নিস্ট ফিল্ম মানে ডগমে ৯৫ নয়। এই, ওই করতে হবে এ ধরনের কোনও ভণিতাসর্বস্ব চেকলিস্ট আমরা বানাইনি।’
শুধু হাঙ্গেরির বেলা টার? ইরানের গৃহবন্দি পরিচালক জাফর পনাহি-র নিজেকে নিয়ে ‘ক্লোজ্ড কার্টেন’ বা ‘দিস ইজ নট আ ফিল্ম’ বলে যে নতুন দুই ছবি, সেখানেও তো সাবজেক্ট বা মুখ্য চরিত্র ঘরবন্দি। জানলার পরদা টেনে ঘর অন্ধকার করে দেওয়া হয়, বাইরে শুধুই অন্ধকার সমুদ্রের গর্জন। থাপ্পড়বান সিনেমা আজ আমেরিকা থেকে এশিয়া সর্বত্র। সেখানেই কাউন্টার কালচার!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.