সোমদীপাকে দেখেই অন্বীক্ষা মুখ ঘুরিয়ে নিল। অন্বীক্ষার মতে সোমদীপা হল ক্লাসের মধ্যে সবচাইতে হিংসুটে মেয়ে। সারদামণি স্কুলে সোমদীপা এ বছরই ভর্তি হয়েছে। সোমদীপা আর অন্বীক্ষা ক্লাস সিক্সে পড়ে। ওদের ক্লাসটিচার পারমিতামিস্ প্রথম দিনেই প্রত্যেকের সিট ঠিক করে দিলেন। অন্বীক্ষা বসল সোমদীপার পাশে। প্রথম ক’দিন সোমদীপাকে খারাপ লাগত না। কিন্তু এক দিন বাংলা ক্লাসে অন্বীক্ষা দশটা বানান ঠিক করে ‘গুড’ পেল। সোমদীপা দুটো বানান ভুল করেছিল। ব্যস, অমনি সোমদীপার মুখটা হাঁড়ি হয়ে গেল। সারাক্ষণ অন্বীক্ষার পাশে বসেও একটা কথা বলল না। এমনকী ফেরার পথে স্কুলবাসেও না। অথচ এর ঠিক দু’দিন পরেই ক্লাসের মধ্যে সোমদীপাই একমাত্র সব ম্যাথস ঠিক করে ‘গুড’ পেয়েছিল। অন্বীক্ষা তখন কিন্তু হাসিমুখে সোমদীপাকে কনগ্র্যাচুলেট করেছিল।
অন্বীক্ষাকে ওর মা অনুশীলা প্রায়ই বলেন, ‘অনুই, কখনও কাউকে হিংসা কোরো না। বরং যে ব্যাপারে হিংসা হবে, সেই জায়গাতে পৌঁছতে চেষ্টা করবে। হিংসা মানুষকে গড়ে না, ধ্বংস করে।’
অন্বীক্ষা এ কথাটা এক বার সোমদীপাকে বলার চেষ্টা করেছিল। তাতে সোমদীপাই উলটে বলেছিল, ‘দাঁড়া পারমিতামিস্ এলে বলব যে তুই আমায় সব সময় হিংসুটে বলিস।’ অন্বীক্ষা তখন বলেছিল, ‘প্লিজ সোমদীপা, মিস্কে কমপ্লেন করিস না। প্রমিস করছি আর কখনও তোকে কিছু বলব না।’
বাড়িতে ফিরে অন্বীক্ষা কেঁদে ওর মাকে বলেছিল, ‘মা নেক্সট পেরেন্টস টিচার্স মিটিং-এ তুমি পারমিতামিস্কে বলবে, আমার সিটটা যেন চেঞ্জ করে দেন। আমি আর সোমদীপার পাশে বসতে চাই না।’ তার উত্তরে মা বলেছিলেন, ‘অনুই, জীবন অনেক বড়। স্কুলের গণ্ডির বাইরে তুমি তো আরও বড় জগতে যাবে। তখন দেখবে আরও কত বিচিত্র প্রকৃতির বা স্বভাবের মানুষ আছে। তা ছাড়া সবাই যে তোমার মনের মতো হবে, এটা ভাবাও ঠিক নয়। জানবে প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই ভাল-খারাপ দুটো দিক আছে। তুমি ওর খারাপ দিকটাই শুধু দেখছ। তাই ওকে পছন্দ করতে পারছ না। ওর ভাল দিকটা দেখার চেষ্টা করো, দেখবে তখন আর অতটা খারাপ লাগবে না।’ |
ছবি: নিলয়কান্তি বিশ্বাস। |
অন্বীক্ষা মায়ের কথায় সায় না দিয়ে মনে মনে বলছিল, তুমি তো জানো না মা, ওকে প্রতিদিন প্রতিটি ক্লাসে সহ্য করা কত কঠিন। ওর কোনও ভাল গুণ নেই, থাকলে এত দিনে জানতে পারতাম।
গতকাল সোমদীপা খুব বাজে কাজ করেছে। কাল অন্বীক্ষা ম্যাথসে ‘গুড’ পেয়েছিল। আবার পরের পিরিয়ডেই অনন্যামিস্ প্রত্যেককে টেন্স ধরেছিলেন। অন্বীক্ষা সব অ্যানসার দিতে পেরেছিল। তাই মিস্ ওকে ডেকে গাল টিপে আদর করেছিলেন।
ব্যস, সোমদীপা আর যায় কোথায়! অন্বীক্ষার সঙ্গে একটা কথা বলা তো দূরের কথা, টিফিনের সময় ডাকল না পর্যন্ত। উলটে মুখ বেঁকিয়ে রাজ্যশ্রী, চন্দ্রিমাদের সঙ্গে বসে টিফিন খেল। অথচ অন্যান্য সময় এই এদের নামেই সোমদীপা কত কথা বলে।
অন্বীক্ষার খুব রাগ হল। পরের পিরিয়ড ছিল সায়েন্সের। চৈতালিমিস্ দুটো কোয়েশ্চেন অন্বীক্ষাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। দুটোই পারল। শুধু তাই নয়, সোমদীপা যে প্রশ্নের উত্তরটা দিতে পারল না, অন্বীক্ষা সেটাও বলে দিয়েছিল। কিন্তু অন্বীক্ষার খেয়াল ছিল না যে ডেস্কের মধ্যে সায়েন্স বইটা খোলা ছিল। সোমদীপা বইটা নিয়ে চৌতালিমিস্কে দেখিয়ে বলল, ‘মিস্, দেখুন অন্বীক্ষা বই দেখে দেখে উত্তর দিয়েছে।’
অন্বীক্ষা মিস্কে বলল, ‘না মিস্, আমি বই দেখিনি। আপনি অন্য কোয়েশ্চেন জিজ্ঞাসা করুন, আমি পারব।’ কিন্তু চৈতালিমিস্ বই খুলে রাখার জন্য অন্বীক্ষাকে খুব বকেছিলেন।
ক্লাস শেষে অন্য বন্ধুরা অবশ্য সোমদীপাকে বলেছিল, ‘মিছিমিছি তুই আজ অন্বীক্ষাকে বকুনি খাওয়ালি কেন রে?’ সোমদীপা বলেছিল, ‘আমি যা দেখেছি, তাই তো মিস্কে বলেছি।’
ফেরার সময় চান্দ্রেয়ী, স্নিগ্ধারা অবশ্য অন্বীক্ষাকে বলছিল, ‘তোর খুব ব্যাড লাক রে, সোমদীপার সঙ্গে তোকে বসতে হচ্ছে।’
এক দিন অন্বীক্ষার সকাল থেকে মাথাব্যথা করছিল। মা বারণ করেছিলেন, তবুও অন্বীক্ষা জোর করে স্কুলে এসেছিল। ওই দিন ওদের স্কুলে ম্যাজিক শো। দেখবে বলে কবে থেকে দিন গুনছে!
টিফিনের পর স্কুলের ম্যাজিক শো-টা হবে। সাজো সাজো রব। কিন্তু অন্বীক্ষার শরীরটা ভাল লাগছিল না মোটেও। মাথা তুলতে পারছে না। পারমিতামিস্ গায়ে হাত দিয়ে বললেন, ‘এ কী, গায়ে তো বেশ জ্বর। তুমি ক্লাসেই বসে থাকো। এই জ্বরগায়ে মাঠে রোদের মধ্যে দাঁড়ালে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তোমার বাড়িতে ফোন করে দিচ্ছি।’
বন্ধুরা মুখে ‘আহা রে’, ‘ব্যাড লাক’ বলে ম্যাজিক দেখতে গেল। শুধু সোমদীপা রয়ে গেল।
অন্বীক্ষা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘ম্যাজিক দেখতে যাবি না?’ সোমদীপা হেসে বলল, ‘যাঃ, তুই একা একা ঘরে বসে থাকবি, আর আমি চলে যাব? আমরা এক বেঞ্চে বসি। আর তোকে এই অবস্থায় রেখে ম্যাজিক দেখতে কি আমার ভাল লাগবে?’
অন্বীক্ষা মাথা নেড়ে বলল, ‘মা একটু পরেই চলে আসবেন। প্লিজ তুই যা। এ রকম ম্যাজিক শো তো হয় না স্কুলে। না গেলে খুব মিস করবি। আমি নেহাত জ্বরে মাথা তুলতে পারছি না বলে যেতে পারছি না।’
সোমদীপা বলল, ‘চুপ করে বসে থাক। কথা বললে মাথাব্যথা বাড়বে। আমি তোর ব্যাগে বইখাতা সব ঢুকিয়ে দিয়েছি।’ অন্বীক্ষা অবাক হয়ে সোমদীপার দিকে তাকিয়ে রইল। মাকে অন্বীক্ষা বলেছিল, সোমদীপাকে চিনিয়ে দেব। আজ মা এলে ও কোন সোমদীপাকে চেনাবে? ম্যাজিশিয়ানের জাদুকাঠিতে এ তো একদম অন্য সোমদীপা। অন্বীক্ষা মনে মনে ভাবল, ভাগ্যিস আজ ওর জ্বরটা হয়েছিল!
|