প্রবন্ধ...
ছায়াসরণিতে আন্তর্জাতিক বাঙালি
মেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা ‘লো ল্যান্ড’ কিনেছেন। প্রেসিডেন্টের সদ্য কেনা খান-কুড়ি বইয়ের মধ্যে ঝুম্পা লাহিড়ীর উপন্যাসখানি যেমন রয়েছে, তেমন রয়েছে খালেদ হোসেইনির ‘দ্য কাইটরানার’। আফগানিস্থানের কথা। আর ঝুম্পার উপন্যাসে অনেকাংশে পশ্চিমবঙ্গের বৃত্তান্ত। টালিগঞ্জ সংলগ্ন এক নাবাল জলাজমির পাশে থাকত মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার। বাবা, মা, দুই ছেলে। উদয়ন ও সুভাষ। এক জন নকশাল, এক জন আমেরিকা। নকশাল পুলিশের হাতে খুন হয়। আমেরিকা টেলিগ্রাম পেয়ে বাড়ি ফেরে: Udayan killed. Come back if you can. আমাদের ত্রিশ থেকে ষাট বছরের বাঙালিদের কাছে, যাঁরা বাংলা গল্প উপন্যাস পড়েন, তাঁদের কাছে এ চেনা আখ্যান। ওবামা আফগানিস্থান চিনবেন, ঝুম্পা উলটিয়ে কলকাতা জানবেন। আমাদের হয়তো ঝুম্পার উপন্যাস পড়তে পড়তে মনে হবে, যাঁদের কথা লিখেছেন, তাঁদের তিনি ভাল করে চেনেন কি? কতকগুলো চেনা ছাঁচ দিয়ে ইংরিজিতে যে আখ্যান তিনি পাক করলেন, তা সেই কালবেলার ক্যারিকেচার হয়ে উঠল না তো? ঝুম্পা ইচ্ছে করে এমন বানিয়েছেন তা বলছি না, হয়ে গেছে। অভিজ্ঞতার খামতিকে অতিক্রম করার জন্য যে হোমওয়ার্ক এক জন লেখককে করতে হয়, ঝুম্পা তা করেননি। যেমন, উদয়নের ছাত্রজীবনের বিবরণ রয়েছে, প্রেমের প্রসঙ্গও, কিন্তু এই বিবরণ ও প্রসঙ্গ রচনার সময় ঝুম্পা এমন কোনও সংলাপ লেখেননি, যা ষাট-সত্তরের কলকাতার বাঙালি ছেলেমেয়েদের আলাদা করে চেনাতে পারে। তাদের রাজনৈতিক রাগ, কৌতুক, প্রেমের আবেগ ও দ্বিধা ষাট-সত্তরের দশকে যে ভাষায় প্রকাশিত হত সেই ভাষা ছাড়া সেই ভাষার ইংরেজিতে অনুসৃষ্টি ছাড়া সময়টাকে চিনব কেমন করে?
সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ উপন্যাসের বাঙালি পাঠক পড়েছেন অনিমেষ-মাধবীলতার বৃত্তান্ত। কলেজে পড়া বাঙালি ছেলেমেয়েদের আপনি-তুমির দ্বিধা, নিজেদের অবস্থা নিয়ে হতাশা ও রাগ প্রকাশ, বদলের রাজনীতি গড়ে তোলা— এ-সবের সঙ্গে শুধু বাংলা ভাষার বিশেষ বুলি, বুকনিরই সংযোগ নেই, কলকাতার যে সমস্ত হোস্টেল, কেবিন, সিঁড়ি, বাড়ি, ছাদ, চিলেকোঠা তাদের খানিকটা ‘স্পেস’ দিত, সে-সবের গভীর আঁতাত আছে। সেই জায়গাগুলোর ছবি না এঁকে ঝুম্পা শুধু শুধু খবরের মতো করে লিখে দেন, Because she went to Presidency, and Calcutta University just next door, she searched for him.... গৌরী কোথায় খুঁজত উদয়নকে? ফুটের বইয়ের দোকান, কফি হাউস— নামগুলো রয়েছে কিন্তু তার কোনও বাস্তব বিবরণ নেই। ‘দেওয়াল’ বা ‘সহচর’-এর মতো উপন্যাসে যে-ভাবে গলি আর বাড়ির বিবরণ দিয়েছিলেন বিমল কর, কলকাতার জনপদকে আঁকার সেই সামর্থ্য ঝুম্পার না-ই থাকতে পারে, কিন্তু উদয়ন আর সুভাষের বাড়ি, প্রতিবেশী? উদয়ন খুন হওয়ার পর তার অনুরাগীরা বাড়িতে এল, কিন্তু ঝুম্পা তাদের দিয়ে কথা বলালেন না। সুভাষ আমেরিকা থেকে ফিরল, কোনও কৌতূহলী প্রতিবেশীর সঙ্গে তার বোঝাপড়া হল না। ষাট-সত্তরের বাঙালি সমাজ কি এমন কথাহারা আর ঔৎসুক্যহীন ছিল! কলকাতার পাড়াগুলি লাভ করেছিল নাগরিক নির্লিপ্তি!
রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কমুনিস’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘সম্মুখ’ পত্রিকায় তিয়াত্তর-চুয়াত্তরে ধারাবাহিক ভাবে। সেখানে রাঘব বেলেঘাটা অঞ্চলের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিকর্মীদের মিটিং, বিতর্ক, মতভেদ লেখার জন্য খুবই ‘বাস্তব’ ভাষা ব্যবহার করেছিলেন। নেতারা অ্যাকশন স্কোয়াডের থেকে সরে যাচ্ছে, খোচড়েরা সজাগ হয়ে উঠছে, সোনা বলছে, ‘তুমি তো জানো এ-সব ঘোড়ার ডিম পোষায় না আমার... মার্কসের অত নম্বর ভলুম, লেলিনের... তার চেয়ে বাবা আমাকে বল গার্ড দিতে, পুলিশের ঘেরাও ভাঙতে...’। সম্প্রতি প্রকাশিত অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘আটটা-ন’টার সূর্য’ কাগজপত্র ঘেঁটে সিরিয়াসলি ষাট-সত্তরের দশককে তুলে ধরতে চেয়েছে। বাঙালি লেখকদের কাছে বিষয়টি এখনও জ্যান্ত। ঝুম্পার উদয়ন বোমা বানাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার, জখম হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে পাঁচিল টপকে বাড়ি ফেরে, এটা শুধু খবর হয়ে থাকে। টাটকা রাজনৈতিক পরিবেশটা উধাও।
নকশাল আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনৈতিক দল কালক্রমে ক্ষমতায় এসেছিল। দীর্ঘ তেত্রিশ বছর বামেরা শাসন করেছিল। শিক্ষায় সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা তলাকে গুণগত ভাবে ওপরে না তুলে ওপরকে টেনে নীচে নামিয়েছিল। ইংরেজি শিক্ষার ভিত ধসিয়ে দিয়ে তারা সাবেকি বাংলা মিডিয়মকে ডকে তুলে দিয়েছিল। নানা কিসিমের ইংলিশ মিডিয়ম স্কুল রমরমিয়ে গড়ে উঠল। ফলে তিরিশের তলায় বুদ্ধিমান ছেলেমেয়েরা সব ইংলিশ মিডিয়ম। তাদের বড় অংশ মহাশ্বেতা, সমরেশ, রাঘব, অশোককুমার পড়বে না, কারণ তাঁরা বাংলায় লিখেছেন। ঝুম্পা লাহিড়ী পড়ে বাঙালি সংস্কৃতির ছায়া-সরণিতে হাঁটবে। আর যারা মাঝারি ইংলিশ মিডিয়ম, তেমন করে কোনও বই পড়ে না, তারা উলটে দেখবে ‘লো ল্যান্ড’-এর বাংলা অনুবাদ। ভাল বাংলা উপন্যাসের ইংরেজি না হোক, ধরে নেওয়া যায় ঝুম্পার বইয়ের বাংলা অনুবাদ হবে। এতে ঝুম্পার কোনও দোষ নেই, ওবামারও নেই।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.