কমার্শিয়াল থিয়েটারের প্রযোজক আর গ্রুপ থিয়েটারের পরিচালক, দুই মেরুকে ধারণ করে তৈরি হয়েছে
কোম্পানি থিয়েটার। সেখানে অভিনেতা আর দল-বদ্ধ নন। গ্রুপ থিয়েটারে কাঁটাতারের বেড়া
ভেঙে পশ্চিমবঙ্গে একটা ‘গ্লাসনস্ত’ এসেছে। আশিস পাঠককে জানালেন ব্রাত্য বসু |
এক ইস্তেহারে আপনি সমসাময়িক থিয়েটারকে নতুন নাম দিয়েছেন ‘কোম্পানি থিয়েটার’। ব্যাপারটা ঠিক কী?
লিয়েবেদেফ ১৭৯৫-এ বাংলায় প্রসেনিয়াম থিয়েটার চালু করেছিলেন। টিকিট কেটে যে কেউ দেখতে পারত তা। কিন্তু পরে প্রায় আশি বছর প্রধানত জমিদারবাড়িতে, প্রাইভেট স্পেসে থিয়েটারের অভিনয় হত। আমন্ত্রিত দর্শকরাই দেখার সুযোগ পেতেন। জমিদারবাবুদের এই থিয়েটার থেকে নিজেদের আলাদা করে নিয়েছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষেরা ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার সময় (১৮৭২) থেকে। সেই শুরু পেশাদার থিয়েটারের। ১৯৪৮-এ ‘বহুরূপী’ দিয়ে জন্ম নিল ‘গ্রুপ থিয়েটার’। এরও পরে কোম্পানি থিয়েটার। গ্রুপ থিয়েটার একটি নিরীক্ষামূলক বৌদ্ধিক চর্চা। মুখ্যত আদর্শভিত্তিক। তার সঙ্গে অর্থের অহি-নকুল সম্পর্ক। কোম্পানি থিয়েটার অর্থকে অচ্ছুত জ্ঞান করে না।
তথাকথিত গ্রুপ থিয়েটারও কি করে? সরকারি সহায়তা তো না হয় টিকে থাকার জন্যই প্রয়োজন। কিন্তু বেসরকারি পুঁজিও কি আজও ব্রাত্য সে থিয়েটারে?
একেবারেই না। কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারের মৌলিক আদর্শ: সঙ্ঘ অর্থ অর্জন করতে পারে, ব্যক্তি মুনাফাবোধ থেকে নিজেকে পরিহার করবে।
আর কোম্পানি থিয়েটার?
অর্থকে অনর্থের মূল কারণ ভাবে না। তার স্ট্র্যাটেজি, গ্রুপ থিয়েটারের পরম্পরায় বিভিন্ন কর-ছাড় সমেত ‘সরকার’ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে কাজে লাগানো আর পেশাদার থিয়েটারের পরম্পরা অনুযায়ী টিকিটের দাম উপরের দিকে রাখা, যাতে অর্থনীতির ভারসাম্যটা রাখা যায়।
অর্থাৎ গ্রুপ থিয়েটারের পরিচালক আর কমার্শিয়াল থিয়েটারের প্রযোজক, কোম্পানি থিয়েটারে এসে এক হয়ে গেলেন? পরিচালক বা দলনেতাদেরই এখানে থিয়েটারটাও ভাবতে হয়, বিজ্ঞাপন, স্পন্সর ইত্যাকার অর্থচিন্তাও করতে হয়?
হ্যাঁ। এই যুগ্মকেই নতুন অর্থনৈতিক সমাজ-প্রতিবেশ মেনে বাজেট করতে হচ্ছে। এক ধরনের সিন্থেসিস। কমার্শিয়াল থিয়েটারের প্রযোজকের অ্যান্টিথিসিস ছিলেন গ্রুপ থিয়েটারের পরিচালক। কোম্পানি থিয়েটার দুই মেরুকে ধারণ করে তৈরি করল নতুন সংশ্লেষ ‘প্রযোজক-পরিচালক’। বাইনারি অপোজিট। তাঁর কাছে অভিনেতা আর দল-বদ্ধ নন। এক দলের অভিনেতা স্বচ্ছন্দে অন্য দলে কাজ করতে পারেন। গ্রুপ থিয়েটারে যে কাঁটাতারের বেড়া সেটা ভেঙে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের থিয়েটারে একটা ‘গ্লাসনস্ত’ নিয়ে এলেন এই প্রযোজক-পরিচালকেরা। ভাঙাটাই সঙ্গত। |
দলের চেয়ে ব্যক্তির বড় হয়ে ওঠা, ফলে দলে ভাঙনের ইতিহাস তো গ্রুপ থিয়েটারেও আছে। শম্ভু মিত্র এবং তৎসংক্রান্ত বিতর্ক...
হ্যাঁ। মজার কথাটা হল, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে মধ্যবিত্তের বিচ্ছিন্নতা প্রথম ঘোষণা করেছিল থিয়েটারই, ন্যাশনাল থিয়েটারের মাধ্যমে। ‘গ্রুপ থিয়েটার’-এ সেই শ্রেণিগত আপত্তি নেই। ছুতমার্গ সেখানে ব্যক্তির যশ এবং মুনাফায়। কিন্তু ইতিহাসের কি পরিহাস, দলগুলো ক্রমশ পরিচালকদের নামে পরিচিত হয়েছে সেখানেও। যৌথ খামার ভাঙতে ভাঙতে টুকরো টুকরো দ্বীপ, মাঝে বাঁকা জল। ভেবে দেখুন, ‘কম্বিনেশন নাইট’সুলভ প্রযোজনা ছাড়া দুই মহৎ কখনও মঞ্চভাগ করেননি। ত্রাণসংগ্রহের জন্যও কখনও এক মঞ্চে অভিনয় করেননি শম্ভু মিত্র ও উৎপল দত্ত, শেখর চট্টোপাধ্যায় ও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বা তৃপ্তি মিত্র ও কেয়া চক্রবর্তী। আদর্শের বেড়া কাজ করেছে। সে বেড়াগুলো ভেঙে গেছে আজ।
আপনার ‘কালিন্দী ব্রাত্যজন’ তা হলে একটা কোম্পানি। আপনি তার প্রযোজক-পরিচালক?
একেবারেই। নিজের থিয়েটারকে আমি গ্রুপ থিয়েটার বলতেই চাই না। শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বাদল সরকার গত ৬৫ বছর ধরে চলে আসা গ্রুপ থিয়েটার নামক ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’টির প্রধান উদ্যোক্তা। তার উত্তরাধিকার নিশ্চয় আছে আমার মধ্যে, কিন্তু আমি তার অংশমাত্র নই। তাঁদের পরবর্তী মেটা-ন্যারেটিভও নই। আমার থিয়েটার কোম্পানি থিয়েটার।
আর এই যে সাত-সাতটা ব্রাত্যজন, উত্তরপাড়া, হাওড়া, খড়দহ ইত্যাদি— এরা সব সেই কোম্পানির শাখা?
না, আলাদা আলাদা কোম্পানি। এর মধ্যে রুগ্ণও আছে কয়েকটা। কেউ বাটার জুতো তৈরি করছে, কেউ ফুটপাতের। আমি কালিন্দী ব্রাত্যজন-এর জুতোর দায়িত্ব নিতে রাজি আছি, অন্যগুলোর নয়।
তা হলে তাঁরা ‘ব্রাত্যজন’ নাম ব্যবহার করছেন কেন?
হয়তো আমার নাট্যাদর্শ বা হয়তো আমার রাজনৈতিক পরিচিতি এঁদের আকৃষ্ট করেছে। সেটা দোষের নয়। তবে এক দিন আমার এই রাজনৈতিক পরিচিতি থাকবে না। আমার থিয়েটারটা কিন্তু, আশা করা যায়, একই রকম থাকবে। অন্য ব্রাত্যজনেরা তখনও দলের নামে আমার নামটা বহন করবেন। আজকের সুবিধা তখন তাঁদের অসুবিধা হতে পারে। সেই ঝুঁকিটাও কিন্তু তাঁরা নিয়েছেন। তা ছাড়া, গ্রুপ থিয়েটারের ইতিহাস মূলত ভাঙার ইতিহাস। নতুন সময়ে হয়তো তাঁরা মনে করছেন একটি ব্যক্তি বা দলকে কেন্দ্র করে একত্রিত হবেন। সে ক্ষেত্রে ‘ব্রাত্যজন’ অনুঘটক।
এক হওয়া কি স্বাস্থ্যের লক্ষণ? তা হলে সৃষ্টিশীল তর্ক উঠবে কোথায়? না কি, কোন অভিনেতা কোন দলের ‘অবৈধ সন্তান’, কোন দল অবৈধ ভাবে অ্যাকাডেমিতে রোববারের শো পায়, সেই তর্কই সার?
থিয়েটারের বাজারটাই খুব ছোট। কার নাটক নিয়ে মিডিয়া কী লিখল, কে কটা রোববার পেল, এ সব এ বাজারে থাকবে। এই বাঘনখগুলো গ্রুপ থিয়েটারেরই উত্তরাধিকার। কিন্তু একসময় এগুলো চলে যাবে। কাজগুলো থাকবে। সে দিন তার মূল্যায়ন হবে। যদি বাংলা ভাষা বাঁচে।
গ্রুপ থিয়েটার কিন্তু কোম্পানি থিয়েটারকে আমল দিচ্ছে না। এ বার জাতীয় নাট্যমেলায় ‘কোম্পানি থিয়েটার’-এর একটিও নাটক নেই!
না দেওয়ারই তো কথা। চেখভের নাটকের আঙ্কল ভানিয়া-র কথা ভাবুন। সে ওই বাগানটার পিছনে পুরো জীবন দিল, কিন্তু নতুন যে একেলে গুঁফো ছোকরারা এল তাদের কি তার পছন্দ করার কথা? নতুন যুগ শুরু হয়েছে। যে যুগটা চলে যাচ্ছে আমি তার বেদনাকে বহন করি, কিন্তু নতুন যুগের উল্লাসটাকে অস্বীকার করি কী করে? |