কেহ কেহ এমন কীর্তি ধরায় রাখিয়া যান, বহু মানুষ তাঁহাদের প্রতিকৃতি ঘরে টাঙাইয়া রাখেন। অধিকাংশ মানুষই এমন কৃতিত্বের অধিকারী নহেন, তাঁহারা নিজ-প্রতিকৃতি নিজেরাই ঘরে টাঙাইয়া তৃপ্ত হন। কিন্তু কোনও অ-কৃতী মানুষ যদি অন্যের ঘরে তাঁহার প্রতিকৃতি টাঙাইয়া আসেন, অদ্ভুত ঘটনা। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলি আসিয়া এই উদ্ভট প্রবণতাটিই দস্তুর হইয়া পড়িয়াছে। নিজের ফোটোগ্রাফ নিজে তুলিলে (সাধারণত ফোনের সাহায্যে) এবং সেই ছবি এই সকল সাইটে পোস্ট করিলে, ছবিটিকে বলে ‘সেল্ফি’। শব্দটিকে অক্সফোর্ড অভিধানের পক্ষ হইতে ২০১৩ সালের ‘বৎসরের শব্দ’ নির্বাচিত করা হইয়াছে, গত বৎসরের তুলনায় ইহার ব্যবহার নাকি ১৭০০০% বৃদ্ধি পাইয়াছে! খ্যাত তারকাগণও কেহ তোয়ালে পরিধান করিয়া সেল্ফি তুলিতেছেন, কেহ পোষা বিড়াল লইয়া, কেহ বিবাহ-চুম্বনকালীন। সম্প্রতি ব্রুকলিন ব্রিজে উঠিয়া এক জন মানুষ ঝাঁপ দিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, তাঁহাকে নিবৃত্ত করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন কিছু লোক, এই ঘটনাটি পিছনে ঘটিতেছে— এমন অবস্থায় এক মহিলা সেল্ফি তুলিয়া সুপ্রচুর নিন্দামন্দের পাত্রী হইয়া গিয়াছেন। তাঁহার নির্বিকার মুখে সেল্ফি তুলিবার ছবিটি আবার এক চিত্রসাংবাদিক তুলিয়া লইয়াছেন, তাহা নিউ ইয়র্ক পোস্ট-এ প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হইয়াছে ‘selfie-ish’ ক্যাপশন দিয়া। মহিলা কিন্তু এমন কিছুই করেন নাই, যাহা বিশেষ নিন্দার্হ। ‘আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ও আমি’ এই মর্মে যখন জগৎ জুড়িয়া প্রত্যেকে নিজের ছবি বিশ্বের অন্য সকলের স্কন্ধে মুহুর্মুহু চাপাইয়া দিতেছে, তখন ‘আত্মহননোন্মুখ জনৈক ও সেই ঘটনার সম্মুখে আমি’ বার্তাবাহী সেল্ফি-টি বরং অতিশয় আকর্ষণীয়। অন্তত ‘শৌচালয়ের সম্মুখে আমি’ তুলিয়া যাহাদের হাত ও হৃদয় দড়কচা মারিয়া গেল, তাহাদের নিকট এই সুযোগ দৈবপ্রেরিত। সম্প্রতি কেরলের এক কারাগারের তিন বন্দি, তুলকালাম ঘটিবে বুঝিয়াও, নিজেদের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করিয়াছে। সেইগুলি ‘সেল্ফি’ নহে, তবে প্রবণতাটি সমান আত্মকণ্ডূয়নধর্মী।
এই আগ্রাসী নার্সিসাসপনা লইয়া প্রকৃত প্রশ্ন: আমার জীবনের অতিশয় সাধারণ একটি মুহূর্তের সাক্ষী থাকিবার গরজ কেহ আদৌ অনুভব করিবে কেন? কেনই বা আমি আমার জীবনটি অনুভব বা উপভোগ করিবার পরিবর্তে অন্যকে ক্রমাগত তাহার নথি জোগান দিয়া চলিতে ব্যস্ত থাকিব? আসলে, এই প্রযুক্তি আসিয়া সহসা অকুলীন সাধারণ মানুষকে আত্মগুরুত্বের বড়ি খাওয়াইয়া দিয়াছে। সারা দিন অতি ক্লান্তিকর ও বিরক্তিকর ঘটনাহীনতায় নিমজ্জিত যে গড় মানুষ একটি শ্বাসও লইবার আগ্রহ পাইত না, আজ তাহার চকিতে মনে হইয়াছে, চারি শত ভার্চুয়াল বান্ধব পাইয়া আমি মহা জনপ্রিয়, তাহারা নির্ঘাত আমার দন্তপ্রক্ষালনের ছবি দেখিতে রুদ্ধশ্বাসে বসিয়া। ইহা মন্দ কাণ্ড নহে। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ কোনও দিনই কিছুই উল্লেখযোগ্য করিয়া উঠিবে না, কেবল দিনগত পাপক্ষয় করিয়া জৃম্ভণাক্রান্ত হইবে। সহসা যদি তাহারা নিজেদের তাৎপর্যপূর্ণ মনে করিয়া শ্লাঘায় ফুলিয়া উঠে, তাহাই কি মর্তে স্বর্গপ্রতিষ্ঠা নহে? অবশ্যই তাহাদের এই ধারণার কোনও যুক্তিভিত্তি নাই, কেবল অসংখ্য মানুষ লিপ্ত রহিয়াছে বলিয়াই এই অন্তঃসারশূন্য হুজুগটি অবশ্যপালনীয় প্রকল্প হিসাবে স্বীকৃতি পাইতেছে ও মূর্খমস্তকের পরিধিময় অলীক জ্যোতিবৃত্ত আঁকিয়া দিতেছে, তবু অশান্তিগ্রস্ত থাকিবার অপেক্ষা ‘প্লাসেবো’-প্রভাবে শান্তিলিপ্ত হওয়া উত্তম। সান্তা ক্লজে বিশ্বাস করিয়া কি মানুষ ভাল থাকিতেছে না? ময়দানে গড্ডলিকাপ্রবাহে চলিতে চলিতে কোনও গড্ডল যদি ফটাস করিয়া একখানি ‘সেল্ফি’ তুলিয়া পোস্ট করিয়া দেয় এবং এই আত্মপ্রসাদ অনুভব করে যে ইহা মহাবিশ্বে এক সাতিশয় বিস্ফোরক কাণ্ড বলিয়া অচিরেই প্রতীয়মান হইবে, তাহা হয়তো বেচারির আশু খড়্গবলিটিকে সহনীয় করিবে। অবশ্য যদি না সে ওই সময়েও ‘সেল্ফি’ তুলিতে ব্যস্ত থাকে! |