বেআইনি অস্ত্র কারবারের এক পাণ্ডাকে গ্রেফতার করল রানিতলা থানার পুলিশ। সিরাজউদ্দিন শেখ নামে ওই ব্যক্তির খোঁজ পুলিশকে দিয়েছে কয়েকজন দুষ্কৃতীই। পুলিশ জানিয়েছে, নানা ঘটনায় ধৃত ওই দুষ্কৃতীরা পুলিশের কাছে জেরার মুখে জানিয়েছে, সিরাজউদ্দিনের কাছ থেকেই তারা আগ্নেয়াস্ত্র ভাড়া করেছিল। ভগবানগোলা ২ ব্লকের রানিতলা থানার বালিগ্রাম পঞ্চায়েতের হোসনাবাদ থেকে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করা হয় সিরাজউদ্দিনকে। তার কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে তিনটে মাসকেট, দু’টো ওয়ান শটার, একটি বন্দুক এবং তিনটে থ্রি নট থ্রি গুলি ও ১২ বোরের আটটি গুলি। |
সিরাজউদ্দিনকে এদিন লালবাগ এসিজেএম আদালতে হাজির করানো হলে বিচারক তাকে চার দিনের পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেফতারের পরে ওই অস্ত্র ব্যবসায়ীকে জেরা করেও অনেক তথ্য পাওয়া গিয়েছে। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “ওই অস্ত্র ব্যবসায়ী ও তার দলবলের কাছ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আগ্নেয়াস্ত্র ভাড়া নিয়ে থাকে। তাদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে সেই আগ্নেয়াস্ত্র গ্রাম্য বিবাদেও ব্যবহার হয়ে থাকে বলে ধৃত ব্যক্তি পুলিশের জেরায় স্বীকার করেছে। চাহিদা অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলির কাছে আগ্নেয়াস্ত্র কখনও ৩ হাজার টাকায়, কখনও আবার ১৫-২০ হাজার টাকায় ভাড়া দিয়ে থাকে তারা।”
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে প্রায় এক লক্ষ ৩০ হাজার টাকার অস্ত্র কিনে নিয়ে আসে সিরাজউদ্দিন ও তার দলবল। তার মধ্যে ছিল ১২টি আগ্নেয়াস্ত্র। এর আগে পুলিশ চারটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে। সেই সময়ে গ্রেফতার করা হয় বেশ কয়েক জনকে। ধৃতদের জেরা করে সিরাজউদ্দিনের খোঁজ পায় পুলিশ। তার খোঁজে পুলিশ রানিতলা এলাকার বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশিও চালায়। বিষয়টি জানার পরেই পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে ওই আগ্নেয়াস্ত্রগুলি হোসনাবাদ গ্রামের বাড়ির কাছেই একটি জমিতে পুঁতে রাখার চেষ্টা করে ওই ব্যক্তি।
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাকে গ্রেফতার করে।
পুলিশ সুপার বলেন, “গুলি ও আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির কারখানাও ছিল। কোনও কারণে ব্যবহার হয়েছে, এমন ১২ বোরের গুলিকে নতুন করে ব্যবহারের উপযুক্ত করে তোলা হত সেখানে। ধৃত ব্যক্তির কাছ এমন তিনটে গুলি উদ্ধার হয়েছে।”
প্রসঙ্গত, গত পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক পর দিন খুন হন পাইরুদ্দিন শেখ ও আজিজুল শেখ। দু’জনেই তাদের কর্মী বলে কংগ্রেসের দাবি। দুষ্কৃতীরা গুলি করে তাদের খুন করে। তার মধ্যে পাইরুদ্দিনের বাড়ি রানিতলা থানার আমডহরা পঞ্চায়েতের লক্ষ্মীনারায়ণপুরে এবং আজিজুল ওই থানারই বালিগ্রাম পঞ্চায়েতের নতুনগ্রামের বাসিন্দা। ওই খুনের ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র-সহ বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করে। ওই ধৃতদের জেরা করেই পুলিশ জানতে পারেওই খুনের ঘটনায় দুষ্কৃতীরা আগ্নেয়াস্ত্র ভাড়া করে। পরে কাজ হাসিলের পরে যাদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছিল, তাদের কাছে তা ফিরিয়ে দেয় তারা।
পুলিশ সুপার বলেন, “ভোটের সময়ে আগ্নেয়াস্ত্রের চাহিদা থাকে সব চেয়ে বেশি। রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের জন্য বেশি দর দিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়। অপেক্ষাকৃত কম দর হয় গ্রাম্য বিবাদের সময়ে। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেও অস্ত্র ব্যবসায়ীরা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অস্ত্র ভাড়া দিয়ে থাকে।” পুলিশ সুপার জানান, মূলত ওয়ান শটার, মাসকেট ও বন্দুকের চাহিদা থাকে বেশি।
সিপিএমের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য অবশ্য জানিয়েছেন, অস্ত্র ভাড়া নেওয়া এবং দেওয়ার বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তাঁর কথায়, “এই ধরনের ঘটনা প্রথম শুনলাম। তবে যারা ভাড়া নেয় এবং যারা ভাড়া দেয়, দু’জনেই সমান অপরাধী। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের কোনও রং দেখা উচিত নয়। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে যে সব বেআইনি অস্ত্র মজুত রয়েছে, পুলিশ প্রশাসনের উচিত অবিলম্বে তা বাজেয়াপ্ত করা।” সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, “অস্ত্র ব্যাপারীদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।” জেলা কংগ্রেসের মুখপাত্র অশোক দাসেরও বক্তব্য, “পুলিশের উচিত গোটা বিষয়টি তদন্ত করে ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সকলকে চিহ্নিত করে তাদের চরমতম শাস্তির ব্যবস্থা করা। তবে পুলিশ সুপার তো সব কিছুই আড়াল করার চেষ্টা করছেন।” তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি হুমায়ুন কবীর বলেন, “তৃণমূল এই ধরনের কোনও ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। খুন-সন্ত্রাসের রাজনীতি কারা করে, তা পুলিশ ও জেলার মানুষের অজানা নয়।” তবে ধৃত ব্যক্তিকে নম্বর প্লেটহীন একটি ছোট গাড়িতে করে রানিতলা থেকে বহরমপুর নিয়ে আসায় রানিতলা থানার ওসি বিপ্লব কর্মকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশ সুপার অবশ্য বলেন, “কোনও ভাবে নম্বর প্লেট খুলে যাওয়ায় ওই গাড়ি নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি।” তিন মাস আগে রানিতলা থানার পুলিশ ওই গাড়িটিকে আটক করে। তারপর থেকে গাড়িটি থানায় পড়ে রয়েছে। অভিযোগ, পুলিশ নম্বর প্লেট খুলে রেখে সে ভাবেই ওই গাড়িটি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় রানিতলা থানা এলাকায়। এদিন রানিতলা থেকে ওই গাড়ি নিয়ে প্রায় ৪৫ কিমি দূরের বহরমপুরে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়েও আসে। |